I met a lady in the meads,
Full beautiful- a faery’s child.
Her hair was long, her foot was light,
And her eyes were wild.
-Keats.
“এইসনে আনারগাছটিতে বহুত আনার ফলিয়াছে। আল্লাহের নেয়ামত থরেবিথরে ঝলমল করিতেছে। কোথায় ছিল এইসকল মেওয়া? আল্লাহ বেহেস্ত হইতে কি একটুকুন নমুদ দৰ্শাইতেছেন বনু-আদমকে? তাহাই বটে! গায়েবী দুনিয়ার নমুদ জাহেবী দুনিয়ার পদুছিয়াছে। আফলাতুন সঠিক কহিয়াছেন! নাকি পাক আল্লাহ যাহা ছিল, না, যাহা নাই সমুদায় সৃষ্টি করেন? বড় ধন্দে পড়িলাম দেখিতেছি।
“অন্যমনস্কভাবে চাহিয়া আছি। আচানক নজর হইল, একটি ক্ষুদ্র হাত, উহাতে একগাছি চুড়ি ঝিলমিল করিতেছে, একটি আনার আঁকড়াইয়া ধরিল। অমনি আওয়াজ দিলাম। দেখিলাম গাছটির আড়ালে কিছু আন্দোলন ঘটিতেছে। উঠিয়া পড়িলাম। একটি বালিকা দৌড়াইয়া জঙ্গলে ঢুকিতেছে। দুইখানি ক্ষুদ্র পা হরিণীর সদৃশ, চুল উপচাইয়া পিঠে পড়িয়াছে এবং একবারের জন্য সে মুহ ঘুরাইয়া বুঝিতে চাহিল জে আমি তাহাকে তাড়া করিতেছি কি না। আমার চক্ষে ছটা বাজিল। বেহেশতের হুরী দেখিলাম কি? কে এই খুব সুর বালিকা? বয়ঃক্রম ছয়-সাত বৎসর হইবে মালুম হয়। দ্বিতীয় দফা পুষ্করিণীর উত্তরপূর্ব কোণে বিজলীর ঝিলিক মারিয়া সে গায়েব হইয়া গেল। তবে এতিখানারই কোন এতিম বালিকা হইবে। শরমেন্দা বোধ করিলাম। এই ঘাটে দাঁড়াইয়া উত্তরের পাড়ে এতিমখানার ঘাটে নজর রাখিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে এতিমখানার খিদমতগার-বাবুর্চি ইরফান এবং মকবুল দেগচি তৈজসাদি ধুইতে বাহির হইল। ইশারায় ডাকিলাম। তাহারা দৌড়াইয়া পশ্চিমের সড়ক ঘুরিয়া এবাদতখানার সদর ফটকে হাজির হইল। পূর্বের জঙ্গল ইলাকায় আমার বিনা হুকুমে কেহ পা দেয় না। লোকসকল জানে জে আমি ওই জঙ্গলে গাছ-লতা-পশু-পাখি সকলের সহিত কথাবার্তা কহি এবং কখনওই জেনদিগের সঙ্গেও মুলাকাত করি।–
“ইরফান এবং মকবুল বহত তাজ্জব হইল। নিজ হস্তে আনার পাড়িতে পুছ করিলাম, এতিমখানায় কতজন এতিম আছে? উহারা কহিল, ‘একুশ জন।’– ‘কম বোধ হইতেছে কেন?’ –’হজরত! উহার, আসে এবং পলাইয়া যায়। কোন মাহিনা পঞ্চাশজন, আবার কমিয়া দশজনও হয়। বুঝিলাম, জিম্মাদাররা কারচুপি করিতেছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা করা দরকার। নয়টি পাকা আনার পাড়িয়া কহিলাম, ‘মাথায় লম্বা চুল, খুবসুরত একটি লেড়কি আছে, হাল্কা দুলা –উহাকে পুরা একটি আনার দিবে। বাকিগুলিন সমান টুকরা করিয়া বাঁটিয়া দিবে। তোমরাও হিস্যা লইও।’ আনারগুলিন দুইজনে লইয়া গেল। উহাদের চেহারায় মালুম হইল জে তাজ্জব এবং খুশী হইয়াছে। আর মনে হইল, এইজন্যই আনার গাছটির জন্ম হইয়াছিল এবং সে এত অধিক মেওয়া ফলাইয়াছিল। এক্ষণে সে নিজেকে খালি করিয়া খুশি হইয়া মিটিমিটি হাসিতেছে। কেন একথা মনে হইল, আল্লাহ জানেন–
“কিছুদিবস বাদ জঙ্গলে ঢুকিয়াছি! আচানক দেখিলাম, জঙ্গল ইলাকার শেষে খোলা টুকরা জমিনে সেই বালিকাটি আপন মনে খেলিতেছে। ঘুরিয়া আমাকে দেখিবামাত্র স্থির হইয়া গেল। বালিকাটির-এ কি দেখিতেছি –চক্ষু দুইটি পিঙ্গলবর্ণ, রোশনি ঝিকমিক করিতেছে! পলকে হরিণী গায়েব হইল। সেইবোজ মগরেব বাদ এতিমখানায় জাইয়া হুকুমজারি করিলাম, ‘ওই লেড়কি জেন না পলাইয়া যায়। আর দেখ, উহাকে বাগদাদী কায়দাবহি (আরবি বর্ণপরিচয়) কিনিয়া দিবে। জালালুদ্দিন উহার শিক্ষার ভার লউক।’ জালালুদ্দিন হাজির ছিল! কহিল, হজরতের হুকুম তামিল করিতে ঢুটি ঘটিবে না।”
২১. পদ্মার চরে ঘুরতে
‘Oh! faciles nimium qui tristia crimina caedis Fluminea tolli posse putatis aqua!’ Fasti–Ovid
রত্নময়ী কেন সেদিন হঠাৎ আমাকে প্রণাম করেছিল, জানি না। খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামের পর বিকেলে ইচ্ছে হল, পদ্মার চরে ঘুরতে যাব। একজন পরিচারিকা চা দিয়ে গেল। তার কাছে জানতে পারলাম, রত্নময়ীর শরীর খারাপ। শুয়ে আছে। নীচে গিয়ে মুন্সিজির খোঁজ করলাম। বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে শুকনো ফোয়ারার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তখন উনি এলেন। কপালে হাত তুলে নিঃশব্দে আদাব দিলেন। বললাম, একটু বেরুব ভাবছি। পাহলোয়ানকে’ আনতে বলুন। মুন্সিজি একটু হেসে বললেন, সে হচ্ছে। রাজবাড়ি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হল, বলুন শুনি। বললাম, কী ধারণা হবে? মুন্সিজি প্রথমে যেন অবাক হলেন। তারপর বললেন, এই বাড়িতে আমি তিরিশ বছর আছি। আমারও তবু যখন ধারণা হয়নি, তখন আপনারই বা কেমন করে হবে? তবে ঠাহর করে দেখুন, বাড়িটার গায়েও মুসলমানি ছাপ। আপনি লালবাগে মোতিমহল দেখেছেন কি? বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ। বাড়িটা নবালি ধাঁচের মনে হচ্ছে! মুন্সি আবদুর রহিম আমার হাত ধরে ফোয়ারার শুকনো বৃত্তাকার মারবেল চত্বরের কাছে নিয়ে গেলেন। পাশাপাশি বসলাম দুজনে। তারপর বললেন, এখান থেকে একক্রোশ দূরে বিহার মুলুক। নবারি আমলে এই বাড়িটার মালিক ছিলেন বিহারের ফতেগঞ্জের এক মুসলমান ফৌজদার। পরে লিটন নামে এক ইংরেজ কিনে নেন। তাঁর কাছে কেনেন অনন্তনারায়ণবাবুর বাবা! তাহলে দেখুন। মুসলমানি আর ইংরেজি দুই জমানা এ বাড়িতে গেছে। অনন্তনারায়ণবাবুর দোষ। নেই। ইংরেজি আর মুসলমানি দুইরকম কেতায় তিনি বড়ো হয়েছেন। নবাববাহাদুরের ক্লাসফ্রেনড ছিলেন ইংলনড দেশে। সেই থেকে দোস্তি। ফলে লালবাগ হাভেলি থেকে মন্নুজান বাইজির এ বাড়িতে আসা। কিছু বুঝলেন? বললাম। মুন্সিজি হাসলেন।–বোঝেননি এখনও। এ বাড়ির চাকর-নোকর-ঝি-আয়া-বাবুর্চি-খানসামা, খাওয়াদাওয়ার রীতি সবেতেই ইংরেজি-মুসলমানি কেতা মিশে আছে। অনন্তনারায়ণবাবুর আত্মীয়স্বজন গোঁড়া হিন্দু এবং তাঁরা বিহারে থাকেন। তাঁরা বহু বছর এ বাড়ির সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। তাতে অনন্তনারায়ণবাবুর আরও সুবিধে হয়েছে। মুসলমানপ্রধান এলাকা। লাঠিয়াল-পাইকবরকন্দাজ সবাই মুসলমান। কর্মচারীরাও বেশির ভাগ মুসলমান। আর প্রজারাও ভাবে, তাদের ‘রাজাবাবু’ আধা-মুসলমান। কলমা পড়তে বাকি! –মুন্সিজি হাসলেন। কিন্তু বাঁকা হাসি। তারপর আস্তে বললেন, একজন ভণ্ড লম্পট, মাতাল– আস্ত শয়তান! তার অধীনে চাকুরি করছি যদি বলেন, তার জবাব শুনুন। জহরত-আরার জন্য! জিগ্যেস করলাম, কে জহরত-আরা? মুন্সিজি দুঃখিত মুখে বললেন, আপনি পিরের খান্দান। মুসলমান। তবু জিজ্ঞেস করছেন? ইচ্ছে হল, একটা কড়া জবাব দিই! কিন্তু বৃদ্ধ লোকটির জন্য কেন কে জানে করুণা হচ্ছিল। চুপ করে থাকলাম। তখন মুন্সিজি বললেন, জহরত-আরা ফারসি কথা। জহরত মানে রত্ন। আরা মানে ছটা। এবার হেসে ফেললাম। বললাম, বুঝেছি। মুন্সিজি বললেন এতটুকু থেকে মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে আসছি। ওর বয়স যখন সাত বছর, তখন ওর মা কড়িকাঠ থেকে ঝুলে– বাধা দিয়ে বললাম, রত্নময়ীর ধারণা, তার মাকে তার বাবা খুন করেছিলেন। মুদি একটু চুপ করে থেকে বললেন, রাজবাড়িতে গুজব রটেছিল। সে-গুজব বাইরেও ছড়িয়েছিল। জহরত-আরার কানে গিয়ে থাকবে। তবে ওর লালন-পালনের কোনো ত্রুটি করেননি অনন্তনারায়ণবাবু। মেমসায়েব রেখে বাড়িতে ইংরেজি শিখিয়েছেন। আমার কাছে নিজের চেষ্টায় আরবি শিখেছে। একজন হিন্দুপণ্ডিত কিছুকাল বাঙলা সংস্কৃত শেখাতেন। পরে জাতিপাতের ভয়ে তিনিও গতিক বুঝে কেটে পড়েন। কিন্তু জহরত-আরা বুদ্ধিমতী। অত্যন্ত মেধাবী। ঝটপট সবকিছু শিখে নেওয়ার ক্ষমতা ওর আছে। বললাম, বাবু গোবিন্দরাম কেমন লোক? মুন্সিজি গম্ভীর মুখে বললেন, খুবই সাচ্চা লোক। কিন্তু মনে হচ্ছে, তিনিও আর থাকবেন না। মালিকের প্রতি আমার মতোই অসন্তুষ্ট। তিনি একজন উদারহৃদয় হিন্দু। জহরত-আরাকে তিনিও আমার মতো স্নেহ করেন। আমরা দুজনে পরামর্শ করেই আপনার আব্বা-হজরতের কাছে ওকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলাম। জমিদারবাবুকে দিয়ে চিঠি আমরা লিখিয়ে নিয়েছিলাম। জানেন তো উনি খুব ভালো ফারসি জানেন। মুন্সি আবদুর রহিম তাঁর শীর্ণ আঙুল খুঁটতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে খাস ছেড়ে ফের বললেন, আপনার আব্বা-হজরতের দয়ায় জহরত-জারার অসুখ একেবারে সেরে গিয়েছিল। কিন্তু আবার কিছুদিন থেকে সেই আগের মতো বেহুঁশ হয়ে পড়ছে। বেশের সময় আরবি জবানে আগের মতো নিজের বাবার বিরুদ্ধে কুৎসিত কথাবার্তা বলছে। মাঘমাসে ব্রহ্মপুরে– আবার দ্রুত বাধা দিয়ে বললাম, রত্নময়ীর দাদার কথা বলুন, শুনি! মুন্সিজি ভীষণ চমকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, জহরত আপনাকে কতটুকু বলেছে জানি না। সদর শহরে থেকে কালেজে পড়ার সময় হরিনারায়ণ স্বদেশীদের পাল্লায় পড়ে। কালেকটারকে গুলি করতে গিয়েছিল। একজন দারোগা মারা পড়ে গুলিতে। কোথায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল জানি না। পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছিল। বিচার চলার সময় জেলহাজত থেকে সে পালিয়ে গেছে। কীভাবে পালাতে। পারল কে জানে? অনন্তনারায়ণবাবুর ব্যাপার তো বললাম। ইংরেজদের সঙ্গেও খুব দহরম মহরম আছে ওঁর। কাজেই ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র বলে ঢোলশহরত জারি। করেছেন। খবরের কাগজেও সেকথা ছাপিয়েছেন– ইংরেজি কাগজে। বুঝলেন। তো? বললাম, বুঝলাম। হরিবাবু কোথায় আছেন, জানেন কি? মুন্সিজি বিষণ্ণভাবে হেসে বললেন, মাঘমাসে ব্ৰহ্মপুর থেকে ফিরে এসে জহরত আমাকে সব বলেছে। আমার ধারণা দাদার সঙ্গে ওর দেখা হওয়াটা উচিত হয়নি। আগে জানলে গোবিন্দবাবুকে নিষেধ করতাম। ব্রহ্মপুর থেকে ফিরে আসার পর থেকেই অসুখটা আবার দেখা দিয়েছে। এখন আমার খালি ভয় হচ্ছে, বেহঁশের ঘোরে বাঙলা জবানে যদি দৈবাৎ দাদার সম্পর্কে কিছু বলে ফেলে, মুশকিল হবে। সরকার হরিনারায়ণকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবেই জেনে রাখুন। আর দেখুন শফিসাহেব! জীবনে অনেক ঠকে শিখেছি, মানুষকে খুন করে মানুষের ভালো করা যায় না। আপনি কজনকে খুন করবেন? এত বড়ো দুনিয়া, এত মানুষ! কতজনের ভালোর জন্য কতজনকে খুন করতে হবে? মুখ মানুষ এই কথাটা কেন বোঝে না যে খুনীর হাতের রক্ত কিছুতেই ধোয়া যায় না! যতই করুন, রক্তের ছাপ হাত থেকে মোছা যাবে না।– দার্শনিক বৃদ্ধের দিকে করুণা এবং বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ রোমান কবি ওভিদের একটি কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল : হায়! যারা ভাবে, হত্যার মতো কদর্য অপরাধ সহজেই নদীর জলে ধোয়া যাবে, তারা কী গোবচারা! শিউরে উঠলাম। বললাম, ‘পাহলোয়ানকে আনতে বলুন সহিসকে। পদ্মার চরে ঘুরে আসি। মুন্সিজিও উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হল, আরও অনেক কথা যেন বলার ছিল।–