চিঠিটি আরবি ভাষায় লেখা। মাত্র দুলাইনের চিঠি? সম্বোধনহীন, বেনামি। “শফিকে রক্ষার জন্য শীঘ্র একজন জিন পাঠান।”
বদিউজ্জামান হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বেটি পাগলি! জমিদারি চালায় কীভাবে?
গোবিন্দরাম বললেন, কর্মচারীরা চালায়। তবে কতদিন এভাবে চলবে জানি । মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব? সত্যই সে এক উন্মাদিনী। হিংস্র প্রকৃতির মেয়ে। তার ভবিষ্যৎ ভেবে ভয় করে।
বদিউজ্জামান কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন, দেখছি।
গোবিন্দরাম বললেন, আমাকে এখনই ফিরতে হবে। খতগুলি দয়া করে যদি–
বদিউজ্জামান হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বললেন, শফি মুর্দা। আমি মুর্দার জন্য জিন্দাদের কাছে খত লিখব না, বাবু! আপনি আসুন।
গোবিন্দরাম ক্ষুব্ধভাবে উঠে দাঁড়ালেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, আপনার ইচ্ছা। তারপর বেরিয়ে গেলেন।
বদিউজ্জামান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এবাদতখানায় ঢুকলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে গালিচার বসলেন। বিকেলের আলো কমে যাচ্ছে। ঘরে আবছা আঁধার! কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ক্রন্দনের পর দুইহাত তুলে মৃদুস্বরে প্রার্থনা করলেন, “আল্লাহ! তুমি জিন ও ইনসান (মানুষ) পয়দা করিয়াছ। আমি এই জিন্দেগিতে কিছু চাহি নাই তোমার কাছে। এক্ষণে মাত্র একজন জিনকে ভিখ মাঙিতেছি। তাহাকে পাঠাইয়া দাও, মালেক!”….
আবরুকে ব-সুদ্-দ খুন-এ-জিগর্ হস্ত দিহদ্
ব-উমিদ-এ-করম-এ-খাজা ব-দারোয়াঁ মা-ফারোশ–
রোজ নানা জায়গা থেকে অসংখ্য চিঠি আসে। মৌলাহাটে ডাকঘরের অন্য দরখাস্ত গেছে। শুনেছি মনজুর হয়ে যাবে। এখনও ডাকঘর ওই হরিণমারায়। দুপুর নাগাদ ডাকপিত্তন এবাদতখানার ফটকে এসে হাঁক মারে, ‘চিঠ্ঠি’! লোকটির মাথায় লাল পাগড়ি, গায়ে খাকি ঢোলা কোর্তা, পরনে ধুতি, পায়ে বেঢপ জুতো। তার গোঁফখানা দেখার মতো। নাক ও কান বেজায় লম্বা। তার কাঁধে ঝোলে চামড়ার প্যাটরা। সে হিন্দু। কিন্তু বুজুর্গদের প্রতি ভক্তিপরায়ণ। বারদুতিনও হাঁকে কখনও। অপেক্ষা করে। তার ভক্তিই তাকে ধৈর্যশীল করে। আমাকে দেখামাত্র সে ব্যস্তভাবে জুতো খুলে ফেলে। বাভিলবাঁধা চিঠিগুলো দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে গেলে সে চিঠির বান্ডিলটা আমার পায়ের কাছে রাখার জন্য নত হয়। তাকে নসিহত করেও ফায়দা হয়নি। সে কি আমাকে ছুঁতে হবে বলে এমন করে? প্রথম-প্রথম এই কথাই ভাবতাম। পরে মনে হয়েছিল, ধারণাটা ঠিক নয়। এর আগেও কত জায়গায় বসবাস করেছি এবং চিঠি এলে হিন্দু ডাকপিওন আমার হাতেই তা তুলে দিয়েছে। কিন্তু সেইসব চিঠি এইসব চিঠি নয়। উর্দু, ফারসি, বাঙলায় লেখা প্রশস্তি, দোয়াপ্রার্থনা, হুজুরের নামে পাঠানো নজরানার টাকা পৌঁছেছে কি না, কার কী কঠিন অসুখ এবং আমার ‘পাক খেদমতে হাজির’ হওয়ার জন্য অনুমতি কিংবা কোনো শরিয়তি বিষয়ে মছলা বা ফতোয়া চাওয়া, এইসব নানা ধরনের চিঠি। মানুষের কত যে সমস্যা! রাগ লাগে, দুঃখ হয়, হাসি পায়। চিঠিগুলি আমাকে নিয়ে অথবা আমি চিঠিগুলি নিয়ে খেলা করি। কোথাকার এক আওরত আমাকে প্রায় স্বপ্নে দেখে। হাসতে হাসতে গম্ভীব হই। এই চিঠির জবাব দিই না। তবু তার চিঠি আসে। বুকে ডর বাজে, কবে না এসে সামনে দাঁড়ায়! তবু এইভাবে যে চিঠি আসে, সেও, বুঝি আল্লাহের কুদরত! শেষ পর্যন্ত এই হয়ে উঠল তাজা, জিন্দা, ছটফটে– হয়তো যন্ত্রণায়, হয়তো আনন্দে চঞ্চল যে দুনিয়া আর জীবন, তাকে দেখার জানালা। এই জানালা দিয়ে মানুষের জীবনের স্পন্দন টের পাই। হাজার-হাজার মুখ। হাজার হাজার আশাষণ-খাহেস। যেন ঘরে বসে বাইরে ঝড় দেখছি। মিছিল দেখছি। সমুন্দর দেখছি। উথাল-পাথাল ঢেউ দেখছি। ছলাৎছলাৎ ঢেউগুলি কি আমাকেও এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে না? ওই ঝড় কি আমাকেও ঝাঁপটা মারছে না? হুঁ–আমিও তো মানুষ। আমার নির্লিপ্ততার আলখেল্লা ফরিদুজ্জামানের কালো পোশাকটির মতোই দুভাগ হয়ে যায়, নাঙ্গা রক্তমাংসের শরীর থরথর করে ওঠে। সেদিন একটি চিঠি পেলাম: ‘আমার ছোট ভাই, তিনবৎসর বয়স, ইন্তেকাল করিয়াছে। হুজুর দোয়া করুন, সে যেন বেহেতে ঠাঁই পায়।’ হাতের লেখা দেখে মনে হল বালিকাই হবে। জবাব দিলাম বাচ্চাদের ইন্তেকাল হইলে বেহেশত সুনিশ্চিত জানি! ‘শোক করিবা না। উহা হারাম।’ চিঠিগুলি বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যেন গোপন সাঁকো তৈরি করেছিল আমার জন্য। তাই দুপুর হলেই ঘাটের সিঁড়ির মাথার উদ্গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বাদশাহি সড়কে দুরে লালপাগড়ি নজর হলেই বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে। আজ কী চিঠি আসছে? কার কী খবর নিয়ে আসছে? শফি –আল্লাহ তার জন্য নিশ্চিত কোনো শক্তিশালী জিন পাঠিয়েছেন। তবু মানুষের মন– আমি মানুষ! ডাকপিত্তন এসে পায়ের কাছে বান্ডিলবাঁধা চিঠির তাড়া রাখল। মানিঅর্ডার ফরম রাখল, তার ওপর কিছু টাকা। তার কানে খাগের কলম গোঁজা ছিল। ছিপিআঁটা একটি দোয়াত ছিল চামড়ার প্যাটরায় একটি খোপে। সবই সসম্ভ্রমে রাখল। দস্তখত করে টাকা চিঠির বান্ডিল তুলে নিলাম। সে ফরম, দোয়াত, কলম তুলে নিল। তারপর মাটি থেকে ধুলো খিমচে মাথায় রাখল! মানুষ মানুষের কাছে কেন ওভাবে নত হবে পাই ভেবে নে। টাকাগুলি এতিমখানার জন্য কয়েকজন পাঠিয়েছেন। এবাদতখানার বারান্দায় বসে চিঠিগুলি পড়তে থাকলাম। একটি পোস্টকার্ড, লাল কালিতে লেখা ফারসি দুলাইন কথা, একটি বয়েং : আবরু-কে ‘রক্ত দিয়ে কেনা ইজ্জত, হে সম্মানিতজন, কোনো স্বার্থের বদলে দারোয়ানের কাছে বেচে দিও না।’ তলায় শুধু ফরাসি ‘রে’ হরফ। র-কে এই ‘র’? আচানক নড়ে উঠলাম। আমার নাম ঠিকানা সাধারণ কালিতে লেখা এবং আংরেজিতে! র, রত্নময়ী! কৃষ্ণপুরের সেই জমিদারকন্যা। বুঝলাম আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শফির কথা। কিন্তু এই বয়েৎ কেন? তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আবিষ্কার করলাম, কালির রঙ সাধারণ লাল নয়। একটু কালচে। জায়গায়-জায়গায় ধ্যাবড়া। ইয়া আল্লাহ! এ কি খুন! রক্ত দিয়ে লিখেছে? কিন্তু কেন এই বয়েৎ লিখল সে? আমি নিজের বা কারুর ইজ্জত কোন্ দারোয়ানের কাছে বিকিয়ে দিতে যাচ্ছি যে এমন হুঁশিয়ারি দিল? মন তোলপাড় হয়ে রইল। শফির বিরুদ্ধে সরকারি হুকুম আমি সাইদাকে গোপন করে রেখেছি। জানি না, ইতিমধ্যে সে-খবর মৌলাহাটে রটেছে কি না। রটলে কেউ না-কেউ আমাকে কি জানাবে না? নাকি শফি হিন্দু হয়ে গেছে এবং আমার কাছে সে মৃত সাব্যস্ত হওয়ায় কেউ একটা আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না? না? দিনটা বড়ো বেসামাল কেটে পেল। সারারাত ঘুম হল না। পরদিন বিকেলে দেখি, বাদশাহি সড়কে একটি কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে কোনো সওয়ার আসছে। ঘোড়সওয়ার এবাদতখানার ফটকের দিকে এসে থামল। একটি গাছে ঘোড়া বেঁধে ফটকের সামনে দাঁড়াল। চিনতে পারলাম। দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি। শুনেছিলাম যে কবে নাকি একদিন এসেছিল। বউবিবিদের মায়ের সম্পত্তির বণ্টননামা করে গেছে। কিন্তু মেজবউবিবি মায়ের সম্পত্তি নেয়নি। খুশি হয়েছিলাম শুনে। আত্মহত্যাকারিণীর সম্পত্তি হারাম। মেজবউবিবি বড় নেককার (পুণ্যবতী) মেয়ে। চৌধুরি লোকটিকে দেখে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। এগিয়ে গিয়ে বললাম, বেশরা, মোছলেমনামধারী লোকদের জন্য এবাদতখানার দরোয়াজা বন্ধ। লোকটিকে রুগণ দেখাচ্ছিল। পোশাকও আংরেজের মাফিক। পাতলুনের ভেতর কামিজ গোঁজা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললাম, কী চাই আপনার? আবার কী নিতে এসেছেন আমার কাছে? যান –আর কিছু দেবার নেই আপনাকে। আমার গলা কাঁপছিল। চোখ ভিজে যাচ্ছিল। ফের বললাম, বলুন কী চাই এবার? বারি। চৌধুরি আস্তে বললেন, হজরত! কিছুই চাই না। আপনার কাছ থেকে যা নিয়ে গিয়েছিলাম, তা আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপনার একটি দস্তখত চাই। বললাম, শফি মুর্দা।বারি চৌধুরি বললেন, আপনার কাছে মুর্দা। কিন্তু জেলার হাজার হাজার মানুষের কাছে সে জিন্দা। তারা তাকে চায়। তারা দস্তখত দিয়েছে। কিন্তু আপনার দস্তখতের দাম তাদের চেয়ে বেশি। কালেকটার সাহেব বলেছেন, যদি শফির আব্বা জিম্মাদার হন যে, ছেলেকে তিনি সরকার-বিরোধী কাজ থেকে দূরে রাখবেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে হুকুম তুলে নেওয়া। হবে। হজরত । আপনাকে জিম্মাদার সত্যিই হতে হবে না, শুধু নামকাওয়াস্তে একটা দস্তখত দিন। শফির আসল জিম্মাদার থাকব আমি।– বারি চৌধুরি চোখ মুছে ফের বলল, সে বেপরোয়া। সে জেলায় মাঝে-মাঝে যাতায়াত করছে। আমার ভয় হয়, কখন পুলিশের সামনে পড়লে তাকে গুলি করে মারবে। তাই তার শুধু বেঁচে থাকার জন্য আপনার দস্তখত চাইছি। কালেকটারসাহেব আপনার নামযশের কথা জানেন। তিনি জানেন, আপনি বুজর্গ পির। আপনি দয়া করে শুধু একটা দস্তখত দিন। শিলমোহরও দিন। বলে সে একটা কাগজ বের করল পকেট থেকে। কাগজটি হাত বাড়িয়ে নিয়েই মনে পড়ে গেল রত্নময়ীর রক্তে লেখা বয়েটি। সঙ্গে-সঙ্গে কাগজটি ছিঁড়ে ফেললাম। দ্রুত পিছন ফিরে চলে এলাম। এবাদতখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কতক্ষণ বসে ছিলাম, স্মরণ হয় না। দরজায় ধাক্কা মারল কেউ। তারপর সাইদার সাড়া পেলাম। ভাবলাম, সে দুখুকে সঙ্গে নিয়ে খানা এনেছে। দরজা খুলে চমকে উঠলাম। সাইদার বোরখার মুখের পর্দা তোলা। দুচোখে কান্না এবং আগুন। আপনি এমন বেদিল (হৃদয়হীন) এমন বেহরম (নির্দয়)! বলে আমার জোব্বা খামচে ধরে বুকে মাথা ভাঙতে লাগল। বুঝলাম, বারি চৌধুরি সাইদাকে সব বলেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেই পোস্টকার্ডটি তুলে সাইদার চোখের সামনে ধরলাম। বয়েটি আবৃত্তি করে বললাম খুন দিয়ে এক হিন্দু মেয়ে এটি লিখেছে। সারা জিন্দেগি খুন দিয়ে কেনা ইজ্জত দারোয়ানের পায়ে বিকিয়ে দিতে বল সাইদা? তখন সাইদা চুপ করে রইল।