বাবু গোবিন্দরাম আসিয়া ছফির
বৃত্তান্ত কহেন আর হুজুর পুত্রকে
রক্ষার জন্য জিন ভেজেন তাহার
বয়ান ।।
জালালুদ্দিন বলল, হজরতে আলা! কিছু কেতাবে গায়েবি (অদৃশ্য) দুনিয়ার কথা লেখা আছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
বদিউজ্জামান একটি গাছের দিকে ছড়ি তুলে বললেন, ওটি কী?
একটি গাছ।
তুমি কি পুরা গাছটি দেখতে পাচ্ছ?
জি, হ্যাঁ।
বদিউজ্জামান একটু হাসলেন।…কথাটা ঠিক হল না জালালুদ্দিন। তুমি কখনই পুরা গাছটিকে দেখতে পাচ্ছ না।
জালালুদ্দিন অবাক হল।…কেন হজরতে আলা?
জালালুদ্দিন! গাছটি আসমানে ভেসে নেই। মাটির তলায় ওর শেকড়-বাকড় আছে। কিন্তু তুমি তা দেখতে পাচ্ছ না। তাহলে দেখো, গাছটির এক অংশ দেখতে পাচ্ছ, সেটা জাহের (দৃশ্য)। অপর অংশ দেখতে পাচ্ছ না, সেটা বাতেন। তাকেই বলে গায়েব।
হুজুরে আলা! এ তো তাহলে মারফতি তত্ত্ব হয়ে গেল!
উঁহু। ওরা জাহেরকে স্বীকার করে না। বলে, জাহের অংশ চোখের ভুল। গায়েব অংশই সত্য। কিন্তু আমি বলি, জাহির-গায়েব উভয়ই সত্য। জাহির হল শরিয়ত, গায়েব হল মারফত।
কিন্তু ইমাম শরিফ বলেছেন–
বাধা দিয়ে হজরত বদিউজ্জামান বললেন, আমি ইমাম শাফির মজহারু (সম্প্রদায়)-ভুক্ত। কিন্তু সেটা শরিয়ত বিষয়ে। জালালুদ্দিন! মারফত বিষয়ে আল্লাহ। আমাকে দিনে-দিনে ইম্ (প্রজ্ঞা) দান করেছেন। গায়েবি দুনিয়া আমার নজর হয়। শরীর আর তার ছায়া যেমন, প্রথমে সেইরকম মালুম হত। তারপর ছায়াকেই আসল জানতে পারলাম।
জালালুদ্দিন খুশি হয়ে বলল, হজরত! আফলাতুনের (প্লেটো) কেতাবে ঠিক এই তত্ত্ব পড়েছি বটে!
আফলাতুনের চেয়ে ইলমদার দুনিয়ায় কমই ছিলেন।
এই সময় আনিসুর সর্দারের মৃদু কাশির শব্দ শোনা গেল। হুজুর ইশারায় ডাকলেন তাঁকে। সম্ভাষণ-বিনিময়ের পর আনিসুর বললেন, সেই জমিদারবাবুর লোক বাবু গোবিন্দরাম হুজুরের মোলকাত মাঙছেন।
বদিউজ্জামান তাঁকে নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন। বাবু গোবিন্দরাম ফটকে ঢুকেই কুঁকে এবাদতখানার একটু মাটি মাথায় রাখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে প্রাঙ্গণে দাঁড়ালেন। হুজুর বললেন, বেটির জিনটি কি আবার জ্বালাতন শুরু করেছে বাবু?
গোবিন্দরাম বললেন, আজ্ঞে না, পিরসাহেব! আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।
জালালুদ্দিন এবং আনিসুর সঙ্গে-সঙ্গে এবাদতখানা থেকে পেরিয়ে গেলেন। হুজুর বললেন, আসুন বাবু, ঘাটে বসে কথা শুনি।
ঘাটের মাথায় মুখোমুখি বসার পর গোবিন্দরাম আস্তে বললেন, আপনি আপনার কনিষ্ঠ পুত্র শফির খবর রাখেন কি?
বদিউজ্জামান মাছের চোখে তাকিয়ে বললেন, সে আমার কাছে মুর্দা (মৃত), বাবু!
গোবিন্দরাম আস্তে বললেন, জেলার কালেকটর বাহাদুর শফিকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসন-দণ্ড জারি করেছেন। এ জেলায় তাকে দেখলেই পুলিশকে গুলি করে মারার হুকুমও জারি হয়েছে।
বদিউজ্জামান ফের একই স্বরে বললেন, সে মুর্দা।
পিরসাহেব! গোবিন্দরামের চোখের কোনায় একফোঁটা জল দেখা গেল। ধরা গলায় বললেন, তার মতো মহদয় যুবক দেখা যায় না। সে জেদি, খেয়ালি, বেপরোয়া বটে। নরহত্যায় তার হাত কাঁপে না। কিন্তু তবু বলব, তার গুণের অত নেই। বিদ্বান পণ্ডিতও এ জেলায় তার তুল্য দেখি না। তার তুল্য সেবাব্রতীও দেখা যায় না। অমন দেশপ্রেমিকও দুর্লভ। গোবিন্দরাম শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আমি নেমকহারাম নই। কিন্তু আমার মালিক জমিদার বাবু অনন্তনারায়ণ ত্রিবেদী বড়ো অত্যাচারী, মদ্যপ এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন। আমি দুবছর হল, চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছি। গত বছর জমিদারবাবু খুন হয়েছেন। তাঁর খুনী কে আমি তাও জানি। কিন্তু–
শফি? বদিউজ্জামান আস্তে বললেন।
গোবিন্দরাম জবাব দিলেন না এ প্রশ্নের। বললেন, শফির বিরুদ্ধে কালেকটর বাহাদুরের ওই হুকুমজারির পিছনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের বড়োমানুষরা
আছে। এমন কী, হরিণমারার বড়োগাজিও আছেন।
বদিউজ্জামান চমকে উঠলেন। ফের আস্তে বললেন, তিনি আর আমার কাছে আসেন না। শুনেছি, সদরশহরে থাকেন। মোছলেম লিগ না কিসের মাথা হয়েছেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন। গোবিন্দরাম একটু চুপ করে থেকে বললেন, জেলায় আপনার নামযশ আছে। আপনি এর বিহিত করুন।
কী করব?
আপনি খত লিখে দিন। বড়োগাজিকে লিখুন। খানবাহাদুর দবিরউদ্দিনকে লিখুন। আর একখানা লিখুন কালেকটার বাহদুরকে। আমি সেই খত নিয়ে যাব। হ্যাঁ, আর-একখানা খত লিখুন দিদারুলকে। তিনিও একজন নামকরা লোক। মুসলিম লিগের জিলা সেক্রেটারি।
দিদারুল! বদিউজ্জামান ক্ষুব্ধভাবে বললেন। সে তবলীগ-উল-এছলাম সমিতি ভেঙে দিয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এখন তিনি মুসলিম লিগের নেতা। বদিউজ্জামান গম্ভীরমুখে বললেন, আমি আজকাল বাইরের দুনিয়ার খবর রাখি । এবাদত-বন্দেগিতে কাটাই। আর শফি আমার কাছে মুর্দা! সে মুসলমানি ছেড়ে আপনাদের জাতি হয়েছে শুনেছি।
গোবিন্দরাম একটু হাসলেন। পিরসাহেব! হিন্দু হওয়া যায় না। হিন্দু হয়ে জন্ম নিতে হয়!
বলেন কী! তাজ্জব কথা!
আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে গোবিন্দরাম সোনার বোম সাজানো পানজাবির পকেট থেকেট একটি চিঠি বের করে দুহাতে দিলেন। খতখানি পড়ে দেখুন!
কার খত?
কৃষ্ণপুরের জমিদারবাবুর মেয়ে– যার জিনকে আপনি ভাগিয়েছিলেন। সে এখন জমিদারির মালিক হয়েছে। তবে দু-তিনটি মহাল বাদে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। সব নীলাম হয়ে গেছে।