“সেই দিবস ঈদের পর সড়কে দাঁড়াইয়া বড়গাজি আমাকে কহেন জে ওই গানটি শাইরি করিয়াছেন জনৈক বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিও তৌহিদের প্রচারক। তাঁহারা ‘ব্রাহ্ম’, পুছ করিলে বড়গাজি যাহা বলেন, শুনিয়া তাজ্জব হইয়া জাই। ব্রাহ্মগণও ‘লাশরিকালাহু’ এই মতে বিশ্বাসী! তাহারা আল্লাহকে নিরাকার ব্রহ্ম কহেন। বুতপরস্থির পৌত্তলিকতার) নিন্দা করেন। মাশাল্লাহ! ওই ‘শাইর’ বাবুকে দেখিতে বড় ইচ্ছা হইল। শুনিলাম জে তিনি বীরভূম জিলার বোলপুর সন্নিকটে। এবাদতখানা বানাইয়া বাস করেন এবং তিনি ওই এবাদতখানা এলাকায় বুত-পরস্তি হারাম বলিয়া হুকুম জারি করিয়াছেন। মারহাবা! মারহাবা!”…..
‘ওয়া দারু লাহাবির রাকমাতায়নে কা আন্নাহা
মারাজিয়ো ওয়ালমিন ফি নাওয়াশের মি সামী—’
–জয়াহের বিন-আবুসালমা*
[* প্রাক-ইসলাম যুগের আরব কবি।]
বালকটি এবাদতখানার পূর্বদিকের জঙ্গল থেকে খুঁড়ি মেরে এসে নীচু পাঁচিলে উঁকি দিচ্ছিল। সে ভাবল, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। পাঁচিল ডিঙিয়ে সে ঢুকে পড়ল। তখন চিনতে পারলাম, মনিরুজ্জামানের ছেলে। মুখ টিপে হেসে নজর রাখলাম দেখি সে কী করে। আনার (ডালিম) গাছের ভেতর ঢুকে গেলে বুঝলাম সে কী করবে! কিছুক্ষণ এবাদতখানার দিকে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে রইল সে। তারপর গাছটা নড়তে থাকল। তখন পাকশালার কিনারা ঘুরে ফুলঝোঁপের আড়াল দিয়ো চুপিচুপি কাছে গেলাম। সে আনারটি ঘেঁড়ার চেষ্টা করছিল। খপ করে হাত ধরে ফেলে বললাম, কমবখত! চোট্টা! হো হো করে হাসছিলাম। সে ভড়কে গিয়েছিল। এবার লাজুক হেসে মুখ নামাল। বললাম, আনার এখনও পাকেনি। এসো, আঞ্জির পেয়ার) পেড়ে দিই। পাশের আঞ্জির গাছ থেকে ডাঁসা কয়েকটা আঞ্জির পেড়ে দিলাম। সে কোর্তায় সেগুলি কোঁচড় করে রাখল। বলল, দাদাজি! আনার কবে পাকবে? বললাম, আর দেরি নেই। এসো, দুভাই মিলে আঞ্জির খেতে-খেতে বাতচিত করি। সে বলল, আম্মা বকবেন। বললাম, বলবে দাদাজির সঙ্গে আঞ্জির খাচ্ছিলাম। তখন। বলল, দাদিজি বকবেন। বললাম, সবাই তোমাকে বকে বুঝি? সে মাথা দোলাল। বললাম, আব্বা বকেন না? বলল, না।…..মুনিরুজ্জামানের ছেলেকে খুব নজর করে দেখে আসছি। ওর দেহে একটুও খুঁত নেই। আল্লাহের কুদরত। তবে বড়ই শরমেন্দা। কিন্তু ঘাটেব সিঁড়িতে বসে আঞ্জির খেতে-খেতে সে আজ জবান খুলে দিল। গেরস্থালি ও দৈনন্দিন যা কিছু ঘটে, সবই খুঁটিয়ে বর্ণনা করল। বুঝলাম, তার সঙ্গে আঞ্জির খাচ্ছি বলে সে আমার সম্পর্কে অস্বস্তি কাটিয়ে ফেলেছে। বলল, কুলসুমবুড়ি (ছাগল) শেয়ালের মুখে মারা পড়েছে। আপনি একটা জিন পাঠাননি কেন, দাদাজি? দাদিজি দুদিন কেঁদেছেন, জানেন? হুঁ, কুলসুমকে বাচ্চা থেকে বড়ো করেছিল সাইদা। ওর দুঃখটা বুঝি। বললাম, তোমার দাদিজিকে বোলো, শেয়ালটাও জিন্দা নেই। তাকেও জিন মেরে ফেলেছে। সে হঠাৎ ফিক করে হাসল। বলল, দাদাজি! কাল খালাআম্মা এসেছিলেন। দাদিজি বলছিলেন, বেটি! তোমার খুশিবেটির সঙ্গে রফির শাদি দেব। আম্মা খুব রাগ করেছিলেন। খাল-আম্মা চলে গেলে বললেন, কেন ওকে ওকথা বললেন? আম্মা কেঁদে ফেললেন।…..হুঁ, এই বালকটি বড় জবান-তোড় (মুখর)। সত্যই সে লাজুক নয়। নুরুজ্জামানের মেয়ে শামিম-আরা ওরফে খুশির সঙ্গে নিজের শাদির কথা নিজের মুখে বলে খুব হাসতে লাগল। বললাম, অ্যাই বেশরম! এখনই শাদির কথা কেন তোমার? বড়ো হও। পাস করো। এলেমদার হও– তবে না শাদি? রফিকুজ্জামান বলল, খুশিকে আমি শাদি করব বুঝি? দাদাজি, আপনি যেন কী। খুশি বড় জংলি, জানেন? আম্মা বলেন, একেবারে ওর নানাজির মতো। দাদাজি, আপনি জানেন তো? এবার আমি প্রাইমারি মক্তব পাস করেছি! দাদিজি বলেছেন, আমি বড়োগাজির মতো কলকাতা। পড়তে যাব। কলকাতা গেছেন আপনি?…হুঁ, সাইদা বেশ গুছিয়ে বসেছে সংসারে। শুধু একটাই ওর কষ্ট –শফিউজ্জামান। পানির দিকে তাকিয়ে রইলাম। উলটো দুনিয়াটি নজর হল। বুক কেঁপে উঠল। তারপর ডাকলাম, কমরুজ্জামান! বালক অবাক হয়ে তাকাল। বলল, কে কমরুজ্জামান? আমি তো রফিকুজ্জামান। একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ– রফিকুজ্জামান! তো তোমার মাথা নাঙ্গা কেন? টুপি পর ্না কেন? হরঘড়ি মাথা ঢেকে থাকবে। বালক বলল, কেন দাদাজি? বললাম, নাঙ্গা শের দেখলে কালা জিন তার টুপি পরিয়ে দেয়। তখন মানুষ খারাপ হয়ে যায়।বলে তার মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিলাম। বালক বলল, দাদাজি! লোকে বলে আপনি মাটিছাড়া হয়ে আসমানে উড়তে পারেন। সত্যি?–চুপ করে আছি দেখে সে তাগিদ দিল, বলুন না দাদাজি? শ্বাস ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ রফিকুজ্জামান। আমি দুনিয়াছাড়া হয়ে আসমানে ভেসে আছি। দেখতে পাচ্ছ না? পাবে। আরও বড়ো হও। জানতে পারবে আমার তকলিফ শী। বালকটি কি কিছু বুঝল? কী করে বুঝবে? হঠাৎ সে চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল, এই রে! আম্মা আমাকে বকবেন। নুন আর দেশলাই কিনতে পয়সা দিয়েছেন। সে কোর্তার পকেট থেকে একটা তামার। পয়সা বের করে দেখাল। তারপর দৌড়ে চলে গেল। সেই সময় মনে ভেসে এল। প্রাচীন এক আরব কবির একটি কবিতা। সুন্দরী রমণীর দেহে আঁকা উল্কির মতো সুন্দর ওই মরুবালুকার ওপর তোমার তাঁবুখানি। প্রাচীন আরবে মেয়েরা উল্কি দেগে নিত দেহে। সাইদা! তোমার জীবনের মরুবালুকার ওপর সুন্দর তাঁবু বেঁধেছ। আর আমি আকাশের ওপর ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি জীবনভর। আমি এক অলীক ঘোড়ার সওয়ার, তার দুটি ডানা আছে। “সফেদ জিনগুলান আমাকে আসমানে উঁচা জায়গায় শাহী তখতে বসাইল। লেকিন আমার দেল বনু-আদমের থাকিয়া জাইল! উহা গোন্ত আর খুন দ্বারা তৈয়ারী।”….