আমলি বা তেঁতুল কীভাবে সংগ্রহ করেছে আয়মনি, সেই গল্প বলতে থাকল। ওদিকে একটা পুকুর আছে। তার নাম জোলাপুকুর। ওদিকটায় জোলাদের পাড়া– সেই যারা তাঁত বোনে। তো সেই পুকুরের পাড়ে অনেক তেঁতুলগাছ আছে। হনুমানের পাল এসে তেঁতুল খায়। যদি তুমি ঢিল ছোড়, হনুমানগুলান কী করবে জান? তোমাকে তেঁতুল ছুঁড়ে মারবে। তখন তুমি আঁচল ভরে কুড়োও যত খুশি। হাস্যমতী আয়মনির ভিজে চুল খুলে গেল হাসির চোটে। বলল, শফি, তুমি তো পিরসাহেবের ছেলে। কত ভালোমন্দ খেয়েছ। আমরা সামান্য চাষাভূষো মানুষ। তোমার সম্মান করার মতো কীই বা আছে?…বলে আযমনি আবার ভাত আনতে গেল। শফির খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড। আর আমলি-দেওয়া পুঁটিমাছটাও ছিল সুস্বাদু। তার আর কোনো অভিমান ছিল না। সে শুধু আয়মনিকে দেখছিল। একটু শৌখিন মনে হচ্ছিল, যুবতীটিকে। তার কানে সোনার বেলকুঁড়ি ঝিলমিল করতে দেখে মনে পড়ছিল, তার মায়ের কানেও এমন বেলকুড়ি নেই। সামান্য পাথর বসানো দুটো দুল আছে, তা হয়তো সোনার নয়। সাইদার হাতের চুড়িগুলিও তাঁর শাশুড়ির জেদে পরা। নৈলে বদিউজ্জামান মৃদু নসিহত করতেন। তাঁর মতে, অলঙ্কারকে ভালোবাসলে শয়তান হাসে। শয়তানকে হাসবার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। আর হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, পয়গম্বরের বালিকাবধূ বিবি আয়েশার শৌখিনতায় পয়গম্বর তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ওই বাহ্যিক সৌন্দর্য কোনো সৌন্দর্য নয়। কারণ তা তোমাকে মৃত্যুর পর আর অনুসরণ করবে না। পক্ষান্তরে মৃত্যুর পর যা তোমার অনুগামী হবে, তা হল তোমার আত্মার সৌন্দর্য। বিবি আয়েশা একবার কানের দুল হারিয়ে ফেলে কী বিপদে না পড়েছিলেন। দুল খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এদিকে পয়গম্বর সদলবলে রওনা হয়ে গেছেন। যে উটের পিঠে চাপানো তাঞ্জামে আয়েশার থাকার কথা, তা পর্দা-ঢাকা। ফলে উটচালক বুতে পারেননি বিবি আয়েশা কোথা । শেষে এক ব্যক্তি সেখানে দৈবাৎ এসে পড়েন এবং হজুরাইনকে দেখে সসম্ভ্রমে নিজের উটে চাপিয়ে পয়গম্বর সকাশে পৌঁছে দেন। পরিণামে বিবি আয়েশার নামে কলঙ্ক রটনাকারীরা কলঙ্ক রটনাব ছিদ্র পায়। আর ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ ঘোষিত হয়। কলঙ্ক রটনাকারীদের জন্য লানৎ (অভিসম্পাত) বর্ষিত হয়। পবিত্র কোরানে একটি সুরা আছে এ-বিষয়ে। সাইদা, তুমি হুশিয়ার! আমার হুজুর পয়গম্বর সাল্লেলাহ আলাইহেস্থাল্লাম বিবি আয়োকে একটু শিক্ষা দিয়েছিলেন মাত্র।
শফি শেষ গ্রাস মুখে তুলে থমকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। উঠোনে যারা এসে দাঁড়িয়েছে এবং শফির দিকে মিটিমিটি হেসে তাকিয়ে আছে, তারা সেই যমজ বোন! এক বোন অপর বোনের অবিকল প্রতিবিম্ব যেন। শফির শরীর মুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল। আয়মনি বলল, আয় রুকু! রোজি আয়! এই দ্যাখ, কাকে ধরে এনেছি। আর ও শফি, এই দেখ দরিবুবুর দুই বেটি। দিলরুখ আর দিল আফরোজ। আমরা বলি রুকু আর রোজি।
বুকু বারান্দায় উঠল। রোজি রান্নাঘরে আয়মনির কাছে গেল। আর রুকু একটু হেসে শফিকে বলল, তখন তুমি রাগ করেছিলে?…
৩. নতুন বাসস্থান
শফি ভাবছিল, কে রোজি আর কে রুকু, সেটা আয়মনি চিনতে পারে কী ভাবে? দুজনের পরনে একই রঙের তাঁতের শাড়ি এবং তারা জামাও পরেছে একই রঙের। স্নান করে ওদের মুখের রঙে চেকনাই ফুটেছে বলেও নয়, দুই বোনের গায়ের রঙ ফরসা। সাইদা বেগমের মতো ফ্যাকাসে ফরসা নয়, একটু লালচে। চাষীবাড়ির মেয়েদের গায়ে কখনও জামা দ্যাখেনি শফি। তা ছাড়া চাষীবাড়ির মেয়েদের গলার স্বরের সেই রুক্ষতাটাও রোজ-রুকুর গলার স্বরে নেই। শফির সন্দেহ জাগছিল এতক্ষণে, এরা নিশ্চয় মিয়াঁবাড়ির মেয়ে।
কিন্তু মিয়াঁবাড়ির শাড়ি পরা মেয়েরা দীঘির ঘাটে স্নান করতে বা জল আনে যাবে, এটাও ভাবা যায় না। শফি ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল।
এদিকে রুকু অনর্গল কথা বলছিল। সে জানতে চাইছিল কিছু। আয়মনি ভাত খেয়ে রোজিকে নিয়ে এ বারান্দায় এলে শফির আড়ষ্টতা কেটে গেল। আর সেই সময় রুকু আয়মনিকে বলল, তোমাদের পিরসায়েবের ছেলে বোবা, আয়মনির খালা! রুকু হাসতে লাগল। একটা কথারও জবাব দেয় না। খালি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে যে!
আয়মনি বারান্দার মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে পানের বাটা থেকে পান সাজতে থাকল। আর ঠোঁটের কোনায় চাপা হাসি। রোজি বুকুর পাশে বসে বলল, পির সায়েবের ছেলে আমাদের ওপর রেগে কাঁই হয়ে আছে।
আয়মনি বলল, ক্যানে? তখন ঘাটে সেই ছড়াটা বলেছিলাম। ‘ফরাজিদের নামাজ পড়া/টেঁকির মতন..’
রুকু রোজির মুখ চেপে ধরে বলল, বড্ড বেহায়া তুই! আবার কেন রাগাচ্ছিস ওকে?
আয়মনি সন্দিগ্ধদৃষ্টে তাকালে শফি এতক্ষণে একটু হাসল। আস্তে বলল, এবার কিন্তু তোমাদেরই টেকির মতন মাথা নাড়তে হবে। আব্বার পাল্লায় পড়েছ, দেখবে কী হয়?
রুকু দ্রুত বলল, কী হবে বলো তো?
রোজি বলল, আমি বলছি শোন্ না। আর কেউ বেরুতে পারব না বাড়ি থেকে। সবচেয়ে বিপদ হবে আয়মনির খালার।
আয়মনি পান গালে ঢুকিয়ে বলল, আমার কিছু হবে না। তোমরা নিজেদেরটা সামলে চলো। এই যে হুট করতেই দুজনে বেরিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়াও, বড়োবাড়ির মেয়ে সব– বিয়ে দিলে অ্যাদ্দিন ছেলেপুলের মা হয়ে যেতে? সে কপট ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে চোখ পাকিয়ে ফের বলল, তোমাদের পায়ে বেড়ি পরাতে। বলছি দরিবুবুকে। থামো একটু!