হিন্দু আওরতগণ মরদগণের সহিত মৌলাহাটে
আগমনকরতঃ ঈদগাহে মুছলমানদিগের হস্তে
রেশমীধাগা বাঁধিয়া দেয় তাহার বয়ান।।
“মাঠের ঈদগাহে সেই বৎসর কাতারে মুছল্লিদিগের জমায়েতে খুত্বপাঠের কালে এছলামের তরিকা (পন্থা) বুঝাইতেছি, আচানক দূরে বাদশাহী সড়কের দিকে নজর হইল। খামোশ রহিলাম। মুসল্লিগণ মুখ ঘুরাইয়া দেখিতে চাহিল, আমি আল্লাহের কোনও প্রকার নমুদ দেখিতেছি কি না। একটি মিছিল আসিতেছিল। বিগত কয়েক মাহিন যাবৎ গুজব রটিতেছিল, হিন্দুগণ মোছলেমদিগের উপর গোস্বা করিয়াছে। বাংলা মুলুক দুই অংশে পৃথক করা হইয়াছে। বড়লাট কারজেন বাহাদুর এবং ঢাকার নবাববাহাদুর ছলিমুল্লাছাহেব পরামর্শকরত এরূপ খণ্ডন করিয়াছেন এবং মোছলেমগণ ইহাতে নাকি অধিক২ ধনদৌলত লাভ করিবে। হিন্দুদিগের গোস্বা হইতেই পারে। তবে আমি ফতোয়া দিয়াছিলাম, আংরেজশাহী বেমতলবে কিছু করে না। তাই হুঁশিয়ার হওয়ার দরকার আছে। বড় গাজীছাহেব এবং দিদারুলের তবলীগ-উল এছলাম সমিতির ভিতর ইহা লইয়া কাজিয়ার কথা শুনিয়াছি। কিন্তু আমি ফতোয়া জারি করি জে এই জিলার মোছলেম বেরাদানের কোনও সুফল নাই। ইহারা কমজোর হইয়া পড়িবে। সেই কারণবশত চালাক আংরেজ-শাহীকে মদত না দেওয়ার জরুরত রহিয়াছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রাম এবং গঞ্জ এবং শহরের হানাফিরা আংরেজশাহীকে মদত দিতেছে। ইহাতে হিন্দুরা মোছলেমদিগের দুশমন হইয়া উঠিতেছে। সুতরাং ওই মিছিল আর ঝাণ্ডা দূর হইতে দেখিয়া বুঝিলাম উহারা হিন্দু, দেলে উর বাজিল। জামাতের সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। কেহ কহিল জে কাফেরগণ আমাদিগের সহিত জঙ্গ করিতে আসিতেছে। পলকে জামাত লণ্ডলঙ হইল। বিস্তর লোক গ্রামের দিকে ছুটিল। আওয়াজ দিতে থাকিল, নারায়ে তকবির। আল্লাহ আকবর! উহারা ঢালতলোয়ার লাঠিবল্লম আনিতে গেল। সেইসময়ে দেখিলাম, মিছিলে আওরত লোকও রহিয়াছে। হট্টগোল থামাইতে চিৎকার করিয়া কহিলাম ‘খামোশ হও!’ উপস্থিত সকলে খামোশ রহিল। তখন কানে আসিল, মিছিল হইতে আওয়াজ আসিতেছে, ‘বন্দে মাতরং!’ জামাতে গাজীভ্রাতা দুইজনাই হাজের ছিলেন। তাঁহারা কহিলেন, হরিণমারার বাবুদিগের দেখা যাইতেছে। বড়গাজী কহিলেন, ডর নাই। উহারা মোছলেম ভ্রাতাদিগের হস্তে রাখী পরাইতে আসিতেছে। মিছিল ঈদগাহের। দিকে ঘুরিল। আনিসুর সর্দারকে হুকুম দিলাম, শীঘ্র জাইয়া মোছলেমদিগের নিবৃত্ত করুন। তিনি ছুটিয়া গেলেন। মিছিলের সম্মুখে বালিকাসকল ছিল। তাহাদের হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা ঝিলমিল করিতেছিল। তাহাদিগের মুখে হাসি ছিল। মাশাল্লাহ!…..
“সেই হিজরী ১২৭৪ সনে আমার আব্বার জওয়ান বয়স এবং আমার বালক বয়সে একবার তামাম হিন্দুস্তানে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহী আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া জঙ্গ লড়িয়াছিল। আমার অজুদ শিহরিত হইল; কাঁপিয়া উঠিলাম। মিম্বার হইতে নামিয়াঁ গেলাম। আমার পেছনে মোছলেমগণ, আমি সম্মুখে। হিন্দুগণ আওয়াজ দিলেন, ‘বন্দে মাতরং!’ আল্লাহের কুদরত! একটি বালিকা, মনে হইল বেহেশতের হুরী হইবেক, ছুটিয়া আসিয়া আমার দক্ষিণ হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা বাঁধিয়া শের (মাথা) বুকাইবামাত্র তাহার দুই কাঁধ ধরিয়া বুকে টানিলাম। আবেগবশত আমার চক্ষু সিক্ত হইল। কহিলাম, ‘বেরাদনে ঔর বহিনে হিন্দুস্তান! আজ পাক খুশির দিবসে পুনরায় আংরেজশাহীর ফেরেববাজির (প্রতারণা/ধূর্তামি) বিরুদ্ধে আমরা মিলিত হইলাম। আল্লাহ আমাকে জে বাড়তি চশম্ (চক্ষু দিয়াছেন, উহা দ্বারা নজর হইতেছে আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে বহুত বড় জঙ্গের জামানা আসিতেছে। তামাম হিন্দুস্তানে সমুন্দরের আওয়াজ উঠিবেক! আপনারা তৈয়ার থাকুন!…..
“বালিকা যুবতী, প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা সকল হিন্দু আরও মোছলেমদিগের হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা বাঁধিয়া দিতেছিল। বালক, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধেরাও সেই কর্মে রত থাকিলেক। তাহার পর উহারা আচানক (গান) গাহিয়া উঠিলেক। দুই কর্ণে অঙ্গুলি পুঁজিব জে হস্ত উঠিল না। বাকরহিত দাঁড়াইয়া রহিলাম। উহারা গাহিতে গাহিতে গ্রাম অভিমুখে গমন করিলেক। পরে গানটি বড়োগাজী আমাকে লিখিয়া দেন। উহা এইরূপ :
বাঙলার মাটি বাঙলার জল
বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান…
“উহারা চলিয়া গেলে আবার ঈদের জামাত শুরু হইল। তৎকালে স্মরণ হইল জে আমি গানা শুনিয়াছি। উহার কৈফিয়ৎ দেওয়া আবশ্যক। তখন পাক হাদিছের একটি বৃত্তান্ত শুনাইলাম। এক দিবস মদিনাশহরে দফ (বাদ্য) বাজাইয়া একটি লোক গানা করিতেছিল। রসুলে আল্লাহ (সাঃ) সেইসময় রাস্তা দিয়া জাইতেছিলেন। তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর দুইকদম বাড়াইয়া কহিলেন জে সম্মুখে ভিড় করিয়া পঁড়াইলে পিছনের কেহ উহাকে দেখিতে পাইবে না। তোমরা যাহারা সম্মুখে আছে, উপবেশন কর। অতএব বেরাদানে এছলাম! কোনও২ কালে গানা জায়েজ। কিন্তু উহার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিতে হয়। উহার উদ্দেশ্যসমুদায় চিন্তা করিতে হয়। এই জে আমি দোয়া পাঠ করি, উহাও একপ্রকার গানা নহে কি? মুয়াজ্জিন জে আজান হাঁকে, উহার সুর আছে। সেই সুর আল্লাহের সৃষ্ট কুলমখলকাতকে (বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে) নাড়া দেয়। বনু-আদম আল্লাহপাকের দিকে মুখ ঘুরায় এবং ছেজফারত হয় নাকি?’…..।