কচি বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখে হাঁটু ভাঁজ করে চাপা স্বরে বলল, জান? গাছটার কাছে দোয়াটা পড়লাম। অমনি ওর সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ও বলল –কী বলল বলো তো?
বৃদ্ধা একটু হাসলেন।…..আমি কি কাহিন আওরত যে গাছের কথা বুঝি?
গাছটা বলল, তোমার বড়োআব্বা আর আমি সুখের সংসার বেঁধে আছি।
তওবা! তওবা! গোনাহ হবে ভাই! ওসব বাত করতে নেই।
আঃ! তুমি জান না, ভালোবাসা এমন জিনিস– যাকে ভালোবাসি, সে যদি বুকে ছুরি মেরে খুন করে, তবু তাকে ভালো না বেসে উপায় থাকে না। আর দাদিমা, ভালোবাসা আর ঘৃণা একই প্রবৃত্তির দুটি দিক। বুঝলে কিছু?
আলুগুলান ফালি-ফালি করে কাট দিকিনি। তা’পরে পোস্তটুকুন বেঁটে দিবি। আমার অজুদে আর জোর নেই …..
গোরস্তানে বেশরা মস্তান আর বদু পিরের
বাহাছ আর বহুত জিনের জজের পর
বিবি কামরুন্নিসার গোর হইতে উঠার বয়ান ।।
হিজরি ১৩২৩ সনের রমজান মাসের ২৭ তারিখে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। আংরেজিনবিশ বড়োগাজি সইদুর রহমান, পরে যিনি জেলবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন, তাঁর বার্ধক্যজনিত স্মৃতিবিভ্রম স্বাভাবিক। তবে তিনি বলে গেছেন, সেটি খ্রীস্টীয় সন ১৯০৫ এবং শীতকাল ছিল এবং তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ইসলামি শাস্ত্রে ওই তারিখের রাত্রিটির নাম ‘শবে কদর’ অর্থাৎ সম্মানের রাত্রি। কারণ ওই তারিখেই প্রথম আল্লাহের পবিত্র বাণী অমর্ত্যলোক থেকে মর্ত্যলোকে বহন করে আনেন ফেরেশতা জিব্রাইল, যা কোরান নামে পরে গ্রন্থিত হয়। তাই মুসলমানরা চান্দ্র মাসের ওই তারিখটিকে পবিত্র মনে করে। প্রার্থনা-দান-ধ্যানে সম্মানিত রাত্রিটিকে বরণ করে। হানাফি আমলে মৌলাহাট গোরস্তানে ওই রাত্রে মৃতদের জন্য প্রার্থনায় দলে-দলে জীবিতরা গিয়ে দাঁড়াত। ফরাজি আমলে সেই ট্রাডিশনে হুজুর বদিউজ্জামান কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। তবে পাকা কবর তৈরি নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। ফলে তার জননী কামরুন্নিসার কবরটি পাকা করার ইচ্ছা সত্ত্বেও শিষ্যরা নিবৃত্ত হয় এবং কবরটি কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। শুধু উত্তরশিয়রে একটি কুঁচফুলের ঘন ঝোঁপ কবরটির স্থান নির্দেশ করত। রমজান মাসে রোজা বা উপবাসব্রত। সূর্যাস্তের পর উপবাসভঙ্গ এবং সান্ধ্য নামাজ। হুজুরের কী ইচ্ছা হয়, মায়ের কবরজেয়ারতে বের হন এবাদতখানা থেকে। অলৌকিকক্ষমতাসম্পন্ন ময়ূরমুখো ছড়িটি তাঁর হাতে ছিল (কথিত আছে, যেহেতু জীবজন্তুর মূর্তি নিষিদ্ধ, তাই ছড়ির বাটটিকে আমজনতা ‘ময়ূর-মুখো’ বলে বর্ণনা করলেও হুজুরের মতে ওটি নিছক নকশা বা অলংকার মাত্র)। তখনও দিনের আলো মুছে যায়নি। হুজুরকে গোরস্তানের দিকে যেতে দেখে একদল লোক সম্মানিত দূরত্বে। তাঁকে অনুসরণ করে। এদের মধ্যে হরিণমারার বড়োগাজিও ঘটনাচক্রে উপস্থিত ছিলেন। হুজুর তাঁর মায়ের কবরের দক্ষিণে পৌঁছলে উত্তর থেকে কুঁচফলের ঝোঁপের গায়ে একটি ঢ্যাঙা জীবন্ত দ্বিপদ প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। তার গায়ে হুজুরের মতোই আলখেল্লা। কিন্তু সেটি কালো রঙের। তার গলায় পাথরের রঙিন মালা ছিল, যা নক্ষত্রের মতো জুজুগ করছিল। তার মাথায় আওরতদের মতো দীর্ঘ কেশ ছিল। তার হাতে একটি প্রকাণ্ড লোহার চিমটে ছিল। সেই চিমটের গোড়ায় আংটা পরানো। ছিল। সে চিমটেটি বুকে ঠুকছিল এবং ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছিল। হুজুর থমকে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে পারেন। তারপর আস্তে বলেন কে তুই? এখানে কী করছিস? সে পালটা পুছ করে, তুই কে? এখানে কী করছিস? হুজুর তার পাক আশবাড়ি (ছড়ি)। তোলেন এবং সেও তার চিমটেটি তোলে। এইবার ছড়ি ও চিমটের মুখ থেকে নীলরঙা। আগুন ঠিকরে পড়তে থাকে। লোকসকল ভয়ে দূরে অবস্থান করে।
হড়ি কহে অরে বেশরা মতন।
নাপাক করিতে আহলি পাক গোরস্থান।।
চিনিটা কহে আগে শুনি তোঁহার কিবা কাম।
লম্পট বুজরুগ হৈলি যাইবি জাহান্নাম।।
ছড়ি কহে চিনিলাম তুহি শা ফরিদ।
মুয়ে হক্ মওলা আর বগলমে ইট।।
এইভাবে শুরু হইল বহুত বড়া জঙ্গ।
মুন্সী মেরাতুল্লা ভনে কহন না জায় রঙ্গ।।
লোককবি মুন্সি মেরাতুল্লার বৃত্তান্ত অনুসারে এরূপ গালিগালাজের পর দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়। শরিয়ত এবং মারফতের সেই বাহাস একবর্ণও লোকেরা বুঝতে পারেনি। মুন্সিজির বৃত্তান্তে সেই মস্তান বাবার কালো আলখেল্লা দুদিকে সরে নাঙ্গা শরীরের প্রকাশ এবং চিমটে দিয়ে বাঁ স্তনের দুআঙুল নীচে জ্বলন্ত পিদিমের মতো ‘কলব’ প্রদর্শন, ডান স্তনের দুআঙুল নীচে লালরঙের ‘রুহ’ প্রদর্শন, বুকের মাঝখানে হলুদরঙের ‘খাফি’ প্রদর্শন, কপালের মাঝখানে শাদারঙের ‘সিরর’ প্রদর্শন, মাথার তালুতে নীলরঙের ‘আখফা’ প্রদর্শন এবং নাভিমূলের নীচে বিজলির ছটার মতো ‘নকস’ প্রদর্শনের বর্ণনা আছে। পক্ষান্তরে হুজুর শুধু ‘তৌহিদ’ (একত্ব) শব্দটি ছাড়া লা-জবাব ছিলেন। এরপর লোকসকল চর্মচক্ষে দেখে, সন্ধ্যাকালীন আকাশের দুইটি নক্ষত্র থেকে দুইদল শাদা জিন এসে দুইজনের পক্ষাবলম্বন করে। গোরস্তানে শনশন শব্দে ঝড় বইতে থাকে। ধুলো ওড়ে। বৃক্ষলতা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। জিনদের হাতে বিজলির তলোয়ার ছিল। তারা ধাতব কণ্ঠস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করছিল। বহুত২ জল্প শুরু হয়ে গেলে লোকসকলের পায়ের তলায় (গোরস্তানে খালি পায়ে যাওয়ার নিয়ম) মাটি কাঁপতে থাকে। তারপর তারা দেখে, হুজুরের আম্মাজান কামরুন্নিসার কবরস্থল ফেটে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং বিবিজি শাদা কাফনপরা অবস্থায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি যুযুধান জিনেদের প্রতি চিৎকার করে বলেন, তফাত যাও! ভাগো! বিব্রত, শরমেন্দা ও ভীত জিনযোদ্ধারা নিজেদের নক্ষত্রাভিমুখে নিমেষে প্রত্যাবর্তন করে। আর বিবিজি প্রথমে উত্তর শিয়রে দাঁড়ানো মস্তানের কপালে সস্নেহে চুম্বন করেন, পরে দক্ষিণদিকে দাঁড়ানো ‘হুজুরে’র কপালে চুম্বন করেন। বিবিজি ক্রন্দন করতে থাকেন। দুইদিক থেকে দুই দ্বিপদ মর্ত্য-সন্তান তাঁর উদ্দেশে নত হন। তখন বিবিজি, শাদা কাফনটাকা মূর্তিটি, আসমানে উত্থিত হন। দুই মানুষ একই স্বরে হাহাকার করে ডাকেন, আম্মা! আম্মাজান! শাদা সেই মূর্তির মাথা আর নিম্নমুখী হয় না। ঊর্ধ্বে ঋজুগতিতে আসমানে বিন্দু হতে-হতে ছায়াপথের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। আর দুই দ্বিপদ মর্ত্যবাসীর মধ্যে বিচিত্র মিলন ঘটে। তাঁরা পরস্পরকে অলিঙ্গন করেন। ক্রন্দন করেন। তারপর মস্তান ও হুজুরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। মস্তান উত্তরে, হুজুর দক্ষিণে, এভাবে ক্রমশ, লোকসকলের প্রতি দৃকপাত না করে দুইজনে দুইদিকে যান। ইহাকে স্ব-স্ব স্থলে প্রত্যাবর্তন কহা যায়।