“প্ৰকাণ্ড হলঘরে দেয়ালচিত্র, জানোয়ারের স্টাফকরা মস্তক, প্রকাণ্ড শ্বেতপাথরের টেবিল, বিবিধ আসন সজ্জিত। ঝাড়বাতি ঝুলিতেছে। মুন্সিজি আমাকে একটি আসনে বসাইয়া একজন ভৃত্যকে দিয়া খবর পাঠাইলেন, বলিলেন, গোবিন্দবাবু মহালে গিয়াছেন। রাজাবাবুও কলিকাতায় তবে কোনো টি ঘটিবে না। এই সময় ভৃত্যটির সঙ্গে হলঘরের একপ্রান্তের গালিচা-মোড়া সোপান বাহিয়া ঝর্নাধারার মতন রত্নময়ী। আসিল। সে ‘আসোলামু আলাইকুম’ সম্ভাষণ করিল না। হাস্যমুখে শুধু কহিল, আমার সৌভাগ্য! আসুন। তাহাকে অনুসরণ করিলাম। মুন্সিজি হয়তো স্তম্ভিত হইয়াছিলেন। দ্বিতলে বারান্দা দিয়া ঘুরিয়া উত্তর-পূর্বকোণে একটি সুসজ্জিত ঘরে। ঢুকিয়া রত্নময়ী বলিল, ওই দেখুন পদ্মা! ওই সেই চর। তাহাকে সেদিনকার মতন অপ্রকৃতি দেখাইতেছিল না। বলিলাম, এ ঘরে কে থাকে? বতুময়ী বলিল, দাদা থাকিতেন এক্ষণে আপনি থাকিবেন। দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া বলিলাম, আমার জন্য আপনি ঝামেলায় পড়িবেন না তো? রত্নময়ীব কোটরত চক্ষুদুটি জ্বলিয়া উঠিল। বলিল একজন মুসলমানীবাইজী অপেক্ষা একজন সৈয়দবংশীয় পিরের সন্তানের স্পর্শে এই প্রাসাদ কি অপবিত্র হইবে? বরং এক্ষণে জাহান্নাম বেহেশতে পরিণত হইল। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, কিন্তু আমি তো ধর্মবিশ্বাসী নহি। সুতরাং বাইজী অপেক্ষাও নারকী শয়তান! রত্নময়ী শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলিল, ডো নো দ্যাট স্যাটান ওয়াজ ওয়ান্স। অলসো অ্যান অ্যাঞ্জেল ইন দা সেমিটিক ট্র্যাডিশন? চমকিত হইয়া বলিলাম, হ্যাঁ, তাহা সত্য। সেই নাকি বিশ্বের প্রথম বিদ্রোহ। শয়তান সর্বচর– অবাধ তাহার অর্থ, বিদ্রোহই কোনো সত্ত্বাকে প্রকৃত স্বাধীন করে। বিদ্রোহই স্বাধীনতার প্রবাহে ভাসাইতে পারে। রত্নময়ী জ্ব কুঞ্চিত করিয়া ঠোঁটের কোণে হাসির কণা রাখিয়া বলিল, এত স্বাধীনতার গৌরব প্রচার কেন? আশা করি, স্বাধীনবালার প্রেমে পড়েন নাই? হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, খুকু অর্থাৎ স্বাধীন বলে, তাহার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নেই। আমিও তদ্রপ প্রেমহীন পুরুষ। রত্নময়ীর কী হইল, সহসা আমার পায়ে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিয়া আস্তে কহিল, ইউ আর অ্যান অ্যাঞ্জেল!”
২০. হুল্ হুল্ জুল্ জুল্ উম্কি বুস্বার জুর্
হজরত সৈয়দ আবুল কাশেম মুহম্মদ বদি-উজ-জামান আল্-হুসায়নি আল্-খুরাসানি জীবনের বাস্তবতাগুলিকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরতে বাজপাখির মতো বেঁকে মাটির দিকে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু বগতি সেই হেগুলি প্রতিবার ব্যর্থ হত। ভূমির স্ত্রীলোকটিকে ধরে ফেলল এবং তাকে তুলে নিয়ে আকাশে চলে গেল। কিন্তু বৃক্ষটি থেকে গেল। বদিউজ্জামান জানলেন, বৃক্ষটি তার বাহন ছিল। মৌলাহাটে বোঁদেব চৌকিদাব হাশেম সেই বাত্রে প্রচণ্ড ঝডেব মুখে পড়ে। অথচ আকাশে মেঘ ছিল না। সে চাঁদের আলো হলুদবর্ণ দেখে ভয় পায়। আব তারপর এবাদতখানাব প্রাঙ্গণে। একটি আকস্মিক ছিপছিপে গড়নেব অজানা গাছ দেখা যায়। সমস্ত গাছই ভুইফোড। কিন্তু এমন বাতাবাতি ভুইফোডেব দৃষ্টান্ত নেই। খববটি ক্রমে চাউব হয়! এবাদতখানায় বিনা হুকুমে ঢোকার উপায় ছিল না। তাই দূব থেকে গাছটি দেখাব জন্য ভিড হত। সেই ভিড এত বাড়তে থাকে যে হজবতে আলা গাছটি কেটে ফেলাব। জন্য হুকুম দেন! হোসেন কাঠবেকে তলব কব হয। সে গাছটিব খুঁড়িতে কুডলেব কোপ মাবলে চেবা গলায় একটি আর্তনাদ ও। কানে সুচের মতো বেঁধে সেই আর্তনাদ। চারদিকের গ্রামগুলিতে মানুষজন তা শুনতে পেয়েছিল। আব গাছটি থেকে বক্ত ছিটকে পড়ে। হোসেন কুড়ল ফেলে পালিয়ে যায়! তখন হজবত গাছটিব সামনে। গিযে এই দোয়াটি পাঠ কবেনঃ ‘হল হুল জুল জুল…..’ কাউকে প্রিয় ও বশীভূত কবতে হলে এই আবৃত্তিতে ‘বহুত ফায়দা হয়, কেতাবে এমত বর্ণিত হইয়াছে। গাছটি ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেটি এখনও এবাদতখানাব ধ্বংসস্তূপের শিবে দাডিযে আছে। তার গোড়ায় ক্ষতচিহ্নটি এখনও স্পষ্ট দেখা যায়। গাছটি কী, কেউ জানে না। এমন গাছ কোথাও কেউ দেখেনি।…..
কচি ।। দোয়াটা আবেকবার বলো না, দাদিমা!
দিলবুখ বেগম ।। হুল হুল জুল জুল উমকি বুসবাব জুব। কচি! কচি! এমন করে কোথায় যাচ্ছিস?
কচি ছুটে বেবিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বাদশাহি সড়কে পিচ পড়েছে। বাসস্টপে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল রিকশো, দোকানপাট, ভিড় ঠেলে সে পাটোয়াবিজির আড়তঘরের পেছন দিয়ে আগাছাব জঙ্গলে ঢুকল। সামনে ধ্বংসস্তূপ। একটি প্রকাণ্ড পেয়ারাগাছ। ঝাঁকড়া কুলগাছ। উঁচু কবরটির শিয়রে সেই অচেনা লম্বা গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। কচি মনে-মনে আবৃত্তি করল দোয়াটি। তারপর গাছটির গায়ে হাত রাখল। শুধু এটুকু বুঝল সে, এই গাছের শিকড়গুলি মাটির তলা দিয়ে তার প্রপিতামহের হাড়গুলি ছুঁয়েছে। সে কবরটির দক্ষিণে গেল। হুজুরের নিষেধ ছিল, যেন তাঁর কবরে সাজবাতি জ্বালানো না হয়, কোনো মাজার তৈয়ার না করা হয়, কোনো ফলক বসানো না হয়– কারণ এগুলিন বেদাত কৰ্ম্ম। কিন্তু সবই হয়েছিল। মারবেল ফলকে ফারসি আর বাঙলায় জন্মমৃতুর সনতারিখ লেখা ছিল। ক্ষয়ে-ফেটে শ্যাওলা ধরে গেছে। আমবুশলতা ঢেকে ফেলেছে ফলকটিকে। শুধু পড়া যায়: ‘জন্ম হিজরি সন ১২৬১…..মৃত্যু হিজরি সন ১৩৪০….. জন্ম বাংলা সন ১২৫১….. মৃত্যু সন ১৩২৭-’ কচি মনে-মনে হিসেব করে অবাক হল। হিজরি সনের হিসেবে ৭৯ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তার প্রপিতামহ। কিন্তু বাঙলা সনের হিসেবে ৭৬ বছর হয়। হিজরি চান্দ্রসন, বাঙলা সৌরসন। এই গণ্ডগোলের কারণ কি তাই? কামালস্যারের মতে, হিজরি সনের হিসেবের চেয়ে বাঙলা সনের হিসেব বেশি নির্ভযোগ্য। তবে বিজ্ঞানসম্মত হিশেব খ্রীস্টীয় সন অনুসারে করা যায়। কামালস্যার তাকে একটি পঞ্জিকাসংক্রান্ত বই দিযেছেন। কচি হন্তদন্ত বাড়ি ফিরল! দিলবুখ বেগম উনুনে ভাত বসিয়ে শুকনো পাতা ঠেলে দিচ্ছিলেন। তাঁব নাতনিটি ছিটগ্রস্ত। আলি-আউলিযা-বুজুর্গদেব বংশ এবকম হয় হযতো। কচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উজ্জ্বল মুখে বলল, দাদিমা! তোমাদের হিসেব বোগাস! তোমার শ্বশুরের জন্ম ইংরেজি ১৮৪৫ সালে, মৃত্যু ১৯২০ সালে। দ্যাট মিস-উনি ৭৫ বছর বেঁচে ছিলেন।