“পাহলোয়ানকে পাইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিলাম! কেন জানি না, আশ্রমিকরা আমার এই ‘ঘোড়ারোগ’টিকে পছন্দ করিতেন না। এই বৎসর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়াছিল। গিয়াসপণ্ডিত তাঁহার কন্যা এবং গৃহস্থালিসহ আশ্রমত্যাগ করেন। এলাকায় তাহার বিরুদ্ধে মুসলমানদের নিন্দামন্দ ইহার অন্যতম কারণ হইতেও পারে, তবে শুনিয়াছিলাম, দেবনারায়ণদার সঙ্গে কোনো বিষয়ে প্রবল মতান্তর উহার উপলক্ষ্য। তাঁহার মতে নাকি ‘ব্রাহ্মগণ যে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্রতী, তাহা শুধু ধর্মকেন্দ্রিক নহে উপরন্তু মধ্যবর্তী প্রায় সাতশত বৎসরের মুসলমান শাসনকালের সভ্যতা-সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ সমন্বয়বাদী ধারাটির প্রতি তাঁহারা শীতল মনোভাব অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা রাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুসলমানদিগের কৃতিত্বের প্রতি অবলোকন করিতেছেন না। তাঁহাদিগের মধ্যে দুই-চারিজন বাদে মোটামুটিভাবে সকলেই সুপ্রাচীন বৈদান্তিক এবং আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন ও সমুদয় তত্ত্বচিন্তাকেই প্রাধান্য দিতেছেন। ইহা শুভ লক্ষণ নহে। মৌলবি গিরিশচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যতিক্রম। পত্রাকারে এটি কলিকাতা হইতে গিয়াসুদ্দিন পরে আমাকে জানান এবং এ বিষয়ে চিন্তা করিতে বলেন। তিনি কলিকাতার তালতলায় তাঁহার আত্মীয় মৌলবি আফতাবুদ্দিনের নিকট আছেন। ‘জাগরণ’ নামে পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হইয়াছেন। উদারহৃদয় কতিপয় অ-ব্রাহ্ম হিন্দুও এই পত্রিকায় লিখিতেছেন!’…..
“অশ্ব-উন্মাদনাবশে ইহার প্রতি গুরুত্ব দিই নাই। মাঝেমাঝে স্বাধীন আসিয়া জানাইত, রেহানা তাহাকে পত্র লেখে। স্বাধীন মুচকি হাসিয়া বলিত, রেহানাকে বিবাহ করিলে সুখী হইত! একদিন পুনরায় সে ওই কথা বলিলে আমিও অনুরূপ কৌতুকে বলিয়া উঠিলাম, জীবনে একজনকে বিবাহ করিলেই হয়তো সুখী হইতাম! স্বাধীন। বলিল, সে কে? বলিলাম, নাম বলিব না। শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, একথা সে সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দিয়াছিল, তাহার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নাই। স্বাধীন সঙ্গে-সঙ্গে গম্ভীর হইয়া স্থানত্যাগ করিল। আমিও হাসিতে গিয়া গম্ভীর হইলাম। এই যুবতাঁকে কি আমি সত্যই ভালোবাসি? না তো! আমার হৃদয়ে ঠিক উহার মতোই নারীপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নাই! তাহা গলিয়া পচিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইয়া পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া গিয়াছে।…
“সেই বৎসর বসন্তকালে ডাকপিওন আমাকে একখানি খাম দিয়া গেল। আমার নামঠিকানা সুন্দর ইংরাজিতে লেখা। খুলিয়া চমকিয়া উঠিলাম।
‘প্রিয় পুরুষমানুষ!
দাওয়াত দিয়াছিলাম। প্রতীক্ষা করিতে করিতে কি চুল পাকিয়া যাইবে? আরবি গ্রন্থে পড়িয়াছি, আরবগণের মধ্যে প্রথা আছে, দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করিলে সে শত্ৰ গণ্য হয়। সৈয়দরা তো আরব। সংপ্রতি শ্ৰীমতী স্বাধীনবালার পত্রে অবগত হইলাম, আপনাকে ঘোড়ারোগে ধরিয়াছে। উত্তম সম্বাদ। আমার প্রেমিক জিনটিরও অবস্থা তাই। সে ঘোড়ার পিঠে আমাকে চাপাইয়া পদ্মার চরে লইয়া যায়। উহার সহিত আপনাকে ডুয়েল লড়াইতে ইচ্ছা করে। চরে। বসিয়া জ্যোৎস্নারাত্রে দেখিব, দুই ঘোড়সওয়ার ডুয়েল লড়িতেছে। অধিক বাক্য নিষ্প্রয়োজন। ইতি-র।
পুনশ্চ : পিতৃদেব তাঁহার প্রিয়তমাসহ কলিকাতাগমন করিয়াছেন। তাই বলিয়া আতিথ্যের ত্রুটি ঘটিবে না। মুন্সিচাচাকে আপনার কথা বলিয়াছি।
“মনস্থির করিতে দুইদিন কাটিয়া গেল। হরিবাবুকে জানাইব কি না, ঠিক করিতে পারিতেছিলাম না। অবশেষে সিদ্ধান্ত করিলাম, কাহাকেও কিছু জানাইব না। তবে দেবনারায়ণদাকে বলিতে হইল বহু বৎসর হইল পিতামাতার চরণদর্শন করি নাই। তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। পরদিন প্রত্যূষে যাত্ৰা করিলাম। কৃষ্ণপুর উত্তরপূর্ব কোণে বিহার সীমান্তে অবস্থিত। দূরত্ব প্রায় আট-নয়ক্রোশ হইবে, শুনিয়াছি। পথিমধ্যে দুই স্থানে বিশ্রাম করিলাম। একবার পথ ভুল করিলাম। গ্রামসমূহের মধ্য দিয়া যাইবার সময় লক্ষ্য করিলাম, সকলেই সপ্রশংস দৃষ্টে আমাকে দেখিতেছে। ভাবিতেছে, না জানি কোন জমিদারনন্দন হইবে! তৎকালে হিন্দু জমিদারদিগকে তাঁহাদের হিন্দু-মুসলমান সকল প্রজা রাজা বলিয়া উল্লেখ করিত। জমিদারবাটীকে ‘রাজবাড়ি’ বলিত। মুসলমান জমিদারের সংখ্যা জেলায় মুষ্টিমেয়। তবে তাঁহাদিকে প্রজারা ‘নবাব’ বলিত না, জমিদারই বলিত। নবাব বলিতে জেলায় শুধু লালবাগের নবাববাহাদুর। ইংরেজ বহু জমিদারকে বিশেষ-বিশেষ উপলক্ষে রাজা খেতাব দিত। তাছাড়া মুসলমান শাসনকালের রাজা খেতাবপ্রাপ্ত কিছু জমিদারও ছিলেন!…..
“মাটির রূপ বদলাইতেছিল। বন্ধুর, বৃক্ষবিরল, উষর প্রান্তর চতুর্দিকে। বামদিকে সড়ক ঘুরিল। ক্রমশ বৃক্ষলতাগুল্মদি দৃষ্টিগোচর হইল। সমতলভূমি ও শস্যক্ষেত্র শ্যামলতা ক্লান্তি দূর করিল। এতক্ষণে বিশাল পদ্ম উত্তরে বিলম্বিত দেখিলাম। তাহার বিশালতা মনোমুগ্ধকর। ক্লোশটাকে দূরত্বে কিছু ইটের বাড়ি দেখিতে পাইলাম। রাস্তায় টাঙ্গা, এক্কা এবং বলদ গাড়ির প্রাচুর্য দেখিয়া বুঝিলাম কৃষ্ণপুর সমৃদ্ধ গঞ্জ হইবেক। এইবার দেহে মুহুর্মুহ শিহরন ঘটিতে থাকিল। গঞ্জে ঢুকিয়া এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলে সে ‘রাজবাড়ি’র রাস্তা দেখাইয়া, এমন কী আমার পশ্চাতে হন্তদন্ত আসিতে থাকিল। বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, রাজবাড়ির চতুর্দিকে গভীর পরিখা। সম্মুখস্থ ফটকের দরজায় একজন সঙীনধারী প্রহরী এবং অপর একজন গোখাপ্রহরী কুকরি কোষবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। পরিখার কাঠের সেতু পার হইলে তাহারা সেলাম দিল। বলিলাম, মুন্সী আবদুর রহিমকে সম্বাদ দাও। আমি ব্ৰহ্মপুর আশ্রম হইতে আসিতেছি। লালবাগের হাভেলিতে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সঙীনধারী একটি দড়ি ধরিয়া টানিল। ভিতরে আবছা ঘণ্টার শব্দ হইল। __ বিশাল কপাটের একাংশে ঘুলঘুলিতে একটি মুখ ভাসিয়া উঠিল এবং অদৃশ্য হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে কপাটের একটি ফোকর খুলিয়া একজন বৃদ্ধ মুসলমান বাহির হইলেন। তিনি যেন ভড়কাইয়া গিয়াছিলেন। মৃদুস্বরে তিনি কিছু বলিলে প্রহরীদ্বয় কপাট খুলিয়া দিল। বলিলাম, আপনিই কি মুন্সিজি? তিনি মৃদু হাস্যে মাথা দোলাইলেন। বলিলেন, আসুন। চারদিকে উচ্চ প্রাচীর, প্রাঙ্গণে বাগিচা, মর্মরমূর্তি, কেন্দ্রে দ্বিতল একটি প্রাসাদ। অন্যদিকে সারবন্দি একতলা ঘর। অনুরূপ একটি ফটক দৃষ্টিগোচর হইল। ঘোড়া হইতে নামিলে একজন লোক ছুটিয়া আসিয়া আমার হাতের লাগাম সবিনয়ে গ্রহণ করিল। মুন্সিজি বলিলেন, আপনার ঘোড়ার সেবাযত্নের ত্রুটি হইবেক না। মকবুল সহিস ঘোড়ার সহিত বাক্যালাপে পটু। বুঝিলাম, ইনি রসিক ব্যক্তি …..।