এক যুবতী খিলখিল করে হেসে উঠল। দাদি। পছন্দ হয় নাকি দেখো। দেখে
বৃদ্ধা ঘুরে কপট ক্রোধে মুঠি তুলে বলল, মর হারামজাদি! লোভ হচ্ছে যদি তুই কর।
যুবতীটিও এগিয়ে এল। বলল, তুমি পিরসাহেবের সঙ্গে এসেছ বুঝি? শফি গম্ভীরমুখে বলল, আমি পিরসাহেবের ছেলে।
সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধা ভিজে থানের কাপড় মাথায় টেনে ঘোমটা দিল। যুবতীটি গ্রাহ্য করল না। সে বলল, তুমি এখানে কী করছ? তোমার আম্মাজানরা তো দরিবুবুর বাড়িতে আছেন। তোমাকে কেউ ডেকে নিয়ে যায়নি?
শফি বিরক্ত হয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছেন না গাড়ির ধুরি ভেঙে গেছে?
যুবতী ভাঙা গাড়ি, বলদ দুটি আর জিনিসপত্রের ভূপটি দেখে নিয়ে বলল, ও। বুঝেছি! তা তুমি চলে এসো আমার সঙ্গে। এসো, এসো। কত বেলা হয়েছে। এখনও হয়তো পেটে কিছু পড়েনি! এসো।
শফি বলল, না।
সে কী? যুবতীটি হাসল। কিছু চুরি যাবে না। আমাদের মৌলাহাটে চোর নাই। আর পিরসাহেবের জিনিসে হাত দিলে তার হাত পুড়ে যাবে না? তুমি এসো তো আমার সঙ্গে।
বৃদ্ধাও বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিছু চুরি যাবে না বাবা। আপনি যান আয়মনির সঙ্গে। আয়মনি, তুই নিয়ে যা বাছাকে। আহা, মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। আয়মনি, নিয়ে যা ভাই!
আয়মনি নিঃসঙ্কোচে শফির কাঁধে হাত রেখে টানল। তার হাতে একগোছা কাঁচের রঙিন চুড়ি। তার ভিজে হাতের স্পর্শ ফিকে আড়ষ্ট করছিল। সে পা বাড়াল। আয়মনি তার কাঁধ ছাড়ল না। রাস্তার ওধারে চষাজমির আলপথে গিয়েও শফির কাঁধটা সে পেছন থেকে ছুঁয়ে রইল।
চষা জমিগুলির শেষে একটা পোড়ো জমি। ঘন কোঙা আর কোবনে ভরা সেই জমির বুক দিয়ে একফালি পথ। শফির আগে তিনজন সদ্যঃঝাতা স্ত্রীলোক হাঁটছিল। বৃদ্ধা সবার শেষে। কেয়াবনের ভেতর গিয়ে আগের স্ত্রীলোকেরা বারবার ঘুরে শফিকে দেখে নিচ্ছিল। কেয়াবনের পর মাটির বাড়িগুলি খড়ের চাল মাথায় চাপিয়ে ঠাসবন্দি দাঁড়িয়ে ছিল। সরু একফালি গলিরাস্তায় ঢুকে টিনের চাল চাপানো একটি বাড়ির দরজার সামনে অগ্রবর্তিনীরা থেমে গেল। এবার আয়মনির হালকা পায়ে সামনে গিয়ে বলল, এসো। দরজার ভেতর ছোট্ট উঠোনে একপাল মুরগি চরছিল। আয়মনি মুরগিগুলিকে হটিয়ে দিল। তারপর আবার বলল, এস।
বারান্দায় তক্তাপোষে এক প্রৌঢ় বসে বাঙলা পুঁথির পাতা ওল্টাচ্ছিল। শক্ত সমর্থ এক মানুষ সে। তার শরীরটি তাগড়াই। খালি গা। পরনে শুধু লুঙ্গি। তার মুখে একরাশ দাড়ি। সে অবাক হয়ে তাকাল। তখন আয়মনি মৃদু হেসে বলল, বাপজি, বলো তো এই ছেলেটা কে?
প্রৌঢ় লোকটি একটু হাসল।….কে রে আয়মনি? আমি তো চিনতে পারছি না।
আয়মনি রহস্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলল, তোমাদের পিরসাহেবের ছেলে। ঘাটের বটতলায় বেচারা একা দাঁড়িয়ে ছিল– না খাওয়া না দাওয়া! ডেকে নিয়ে এলাম।
আয়মনির বাবা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।….আসুন, আসুন বাবা! কী কাণ্ড দেখ। দিকিনি! ওদিকে-সবাই পিরসাহেবকে নিয়ে মত্ত। কারুর কি খ্যাল নাই এদিকে? এইমাত্র মসজিদ থেকে আসছি। জানতে পারলে তো–
আমনি বলল, বাপজি! শিগগির বটতলায় যাও দিকিনি! ধুরি ভেঙে গাড়ি পড়ে আছে। জিনিসপত্র পড়ে আছে। কারুর খ্যাল নাইকো। তুমি যেয়ে দেখো কী। ব্যবস্থা হল।
আয়মনির বাবা বারান্দার আলনা থেকে একটা ফতুয়া টেনে ঝটপট পরল। তাক থেকে তালশিরের তৈরি টুপিটাও নিয়ে পরতে ভুলল না। তারপর সে বেরিয়ে গেল। শফিকে তত্তাপোষে বসিয়ে আয়মনি শুকনো কাপড় পরতে গেল ঘরের ভেতর। শফি দেখল, তক্তাপোষে পড়ে থাকা পুঁথিটা কাছাছল অম্বিয়া। পয়গম্বর এবং বুজুর্গ পুরুষদের কাহিনী। আয়মনি শুকনো শাড়ি জড়িয়ে পেতলের বদনায় জল আনল। বলল, হাতে মুখে পানি দিয়ে নাও ভাই! এবেলা আর গোসল করতে হবে না।
শফি উঁচু বারান্দায় বসে হাত-পা-মুখ ধুয়ে ফেললে আয়মনি তাকে একটা গামছাও দিল। একটু পরে সেই তাপোশে মাদুর আর তার ওপর ফুল-লতা-পাতার নকশাওয়ালা একটুকরো দস্তরখান বিছিয়ে তাকে দেখতে দিল। আয়মনি পাখা নেড়ে হাওয়া দিতে দিতে বলল, তোমাকে খাওয়াবার কপাল হবে সে কি জানতাম? তাহলে তো মুরগি জবাই করে রাখতাম। সে কথা বলতে বলতে বারবার হাসছিল। তার কোনোরকমে আটকে রাখা ভিজে চুল থেকে টপটপ করে জল ঝরে পিঠের দিকের কাপড় ভিজে যাচ্ছিল। আয়মনি বলছিল, আম্মাজানের জন্য ভেব না। ওঁরা দরিবুবুর বাড়িতে আছেন। ওই যে দেখছ তালগাছ, ওটাই দরিবুবুর বাড়ি। দরিবুবুরা বড়লোক। কোনো অযত্ন হবে না। দরিবুবুর বাড়িতে এক্ষুনি খবর পাঠাচ্ছি তোমার নাম কী ভাই?
শফি আস্তে আস্তে বলল, শফিউজ্জামান।
আয়মনি আবার হেসে উঠল। অত খটোমটো নাম আমার মনে থাকবে না। আমি শফি বলব। কেমন?
শফি একটা তরকারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে সন্দিগ্ধভাবে জানতে চাইল, এটা কী। আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল আয়মনি। মোন খাওনি কখনও? রূপমতীর বিল থেকে বেচতে এসেছিল আজ। বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে তো! বিলে খালি পদ্ম আর পদ্ম। তুমি দেখে অবাক হবে দুনিয়ার সব পদ্ম কি রূপমতীর বিলেই পুঁতে দিয়েছিল খোদা? সেই পদ্মের শেকড়ের ভেতর থাকে মোলান। কেউ কেউ বলে মুলান। চিবিয়ে দেখো, কী মিষ্টি, কী তার স্বাদ! আমি তো কাঁচাই খেয়ে ফেলেছি। আর শফি, তুমি ভাই এগুলো খাচ্ছ না। খাও। খেয়ে বলল তো কী জিনিস?– পারলে না তো? চ্যাং মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে মাসগুলান মুসুরির ডালের সঙ্গে বেটে বড়া করেছি। তুমি আমলি খাও তো? আমলি-দেওয়া পুঁটি মাছ পেলে আমার তো আর কিছু রোচে না।