একটা কিছু ঘটেছিল, তাব প্রকৃত বর্ণনা আর পাওয়া যাবে না। শুধু এইটুকু বোঝা যায়, মৌলানা বদিউজ্জামান মৌলাহাট অঞ্চলে বদুপির নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে কিছু গল্পও পল্লবিত হয়ে থাকবে। যেমন, জিনেরা তাঁর সঙ্গে ধর্ম আলোচনা করতে আসত, গোরস্থানে মৃতেরা তাঁর ‘আসোলামু আলাইকুম সম্ভাষণের জবাব দিত। তবে তার চেয়ে বড় কথা, মৌলাহাটের পায়ের তলায় ব্রাহ্মণী নদীতে পিরের সাঁকোটি পিরতন্ত্রের মহিমা প্রচার করে এসেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারা বংশপরম্পরা প্রতীক্ষা করত সেইরকম কোনো অলৌকিক শক্তিধর পুরুষ তাদের সামনে এসে দাঁড়ান। আর চৈত্রের সেই দুপুরে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের পটে শাদা পোশাকপরা গৌরবর্ণ সুন্দর সেই পুরুষকে দেখামাত্র তারা বুঝতে পেরে থাকবে, এই সেই মোজেজাসম্পন্ন মানুষ, যার কথা তাদের পিতা-পিতামহ প্রপিতামহরা বলে এসেছে। তারা যখন মিছিল করে তাঁকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল রাস্তার দুধারে আরও মানুষ সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। স্ত্রীলোকেরা জানালা-দরজার ফাঁকে বা পাঁচিলেব চাষের মই ঠেকিয়ে তাতে সাবধানে উঠে গিয়ে উঁকি মারছিল। কিছু বেহায়া বা স্বৈরিণী স্ত্রীলোক পুরুষদের ভিড়েই দাঁড়িয়েছিল। পুরুষেরা তাদের তাড়া করে বাড়িতে ঢোকাল। আরও বহু পুরুষ উঁকি মেরে থাকা খ্রীলোকদের হাত-ইশারায় সরে যেতে বলল। তারা দ্রু কুঞ্চিত করে হুঁশিয়ারি দিয়ে আগে-আগে হাঁটছিল।
বস্তুত মৌলাহাটের মুসলমানদের জীবনে সে ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। উৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বদিউজ্জামান সোজা গিয়ে মসজিদে ঢুকেছিলেন। প্রকাণ্ড মসজিদটি পাকা। প্রাঙ্গণে ইঁদারা ছিল। জোহরের নামাজের সময় এত ভিড় হল যে রাস্তা অব্দি তালাই বিছিয়ে নামাজ পড়তে হয়েছিল।
আর তখন দীঘির ঘাটে বটতলায় শুধু দুটি গাড়ি। একটি সাইদা আর তাঁর শাশুড়ির। অন্যটি বেচারা নকিবের। বাকি গাড়িগুলি লোকেরা এসে নিয়ে গেছে। সাইদার পর্দার অন্য প্রান্ত বটের ঝুরির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে। সাইদা তাঁর প্রতিবন্ধী মেজ ছেলেকে গুড়মুড়ি খাওয়াচ্ছিলেন। শফি নকিবের কাছে দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকটি স্ত্রীলোককে চাদর মুড়ি দিয়ে হদন্ত হয়ে আসতে দেখল সে। স্ত্রীলোকেরা পর্দার আড়ালে সাইদার কাছে গেলে নকিব করুণ হেসে বলল, আম্মাজানদের বেবস্থা হল। এবারে আমার হলে বাঁচি।
একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক পর্দা থেকে বেরিয়ে সোজা নকিবের কাছে এল। ঘোমটার আড়াল থেকে সে বলল, বিবিজিদের গাড়িখানা বলদ জুতে নিয়ে এসো বাবা!
নকিব বলল, তা না হয় যাচ্ছি। কিন্তু এ গাড়ির ধুরি যে ভাঙা! এত সব জিনিস পড়ে রইল।
স্ত্রীলোকটি শফিকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, এই ছেলেটা থাকবে। তুমি এসো বাপু! বিবিজিরা বললেন, নমাজের অক্ত (সময) যাচ্ছে। জলদি করো!
সাইদাদের নিয়ে গাড়িটি চলে গেল। ওই গাড়ির আসল গাড়োয়ান তখন গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ছে। শফি তার ওপর বিরক্ত হয়ে বসে রইল। সে এখানে থাকলে অদ্ভুত নকিব তার কাছে থাকত। নির্জন বটতলায় দুটি জাবনা-খাওয়া গোৰু, একটা ভাঙা গাড়ি আর গেরস্থালির জিনিসপত্রের পাহারায় তাকে একা রেখে সব চলে গেল! অভিমানে গম্ভীর হয়ে রইল সে।
শেষ বসন্তে বটগাছটিতে চিকন কচি পাতা, আর সাতভাই নামে মেটে-ধূসর রঙের পাখিগুলি কলরব করছিল। বাদশাহি সড়কে ধুলো উড়ছিল। মাঝে মাঝে শূন্য মাঠ থেকে ঘূর্ণি হাওয়া খড়কুটো, শুকনো পাতা আর ধুলোর শরীর নিয়ে সড়ক পেরিয়ে যাচ্ছিল। ওপাশে পোডড়া জমিতে কোঙাগাছের নীল-শাদা ঝকঝকে জঙ্গলের ওপর গিয়ে প্রচণ্ড হুলস্থুল। তারপর কোথায় হনুমান ডকল। শফি তার ছিপটিটা শক্ত করে ধরে হনুমানের দলটাকে খুঁজতে থাকল। তার অস্বস্তি হচ্ছিল। এবার তাকে একা পেয়ে সেই কালো জিনটা যদি হনুমান লেলিয়ে দেয়। দীঘির ঘাটে ততক্ষণে একজন-দুজন করে মেয়েরা স্নান করতে এসেছে। তাকে দেখে তারা ঘোমটা টেনে কিছু বলাবলি করছিল। শফির অস্বস্তিটা তাদের দেখতে পেয়েই চলে গেল। তখন সে পাখিগুলিকে তাড়া করল। একটি কাঠবেড়ালির পেছনে লাগল। আসলে সে আর তত বালক নয় সে প্রকৃতির এইসব ছোটখাট জিনিসগুলি তার আগ্রহের সঞ্চার করে, কিংবা সেগুলি তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে। সে তাকে একলা ফেলে রেখে যাওয়ার অভিমান এড়াতে চাইছিল। সে অবাক হচ্ছিল ভেবে, তার মাও তাকে কিছু বলে গেলেন না! তার কথা সবাই ভুলে গেল কেন?
হয়তো সেই শেষ বসন্তের দিনটিতে সেই প্রথম শফি এই বিরাট, পৃথিবীতে একা হয়ে গিয়েছিল, পিছিয়ে পড়েছিল দলভ্রষ্ট হয়ে– তারপর বাকি জীবন সে একা হয়েই বেঁচে ছিল। জীবনে বহুবার অস্থিরতার মধ্যে ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত শফিউজ্জামানের আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে যেত মৌলাহাটের দক্ষিণপ্রান্তে শাহি মসজিদের নিচে প্রকাণ্ড বটতলায় একলা হয়ে পড়ার ঘটনাটি। সেদিন যেন সবাই তাকে ভুলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই ভুলেই রইল।
কিন্তু স্নানার্থিনীরা যখন চলে যাচ্ছে, তখন তাদের একজন শফিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। সে এক বৃদ্ধা। সে থপথপ করে একটু এগিয়ে এসে শফিকে একটু দেখল তারপর ফোকলা মুখে একটু হেসে বলল, বড় সোন্দর ছেলে। কে বাবা তুমি?