–আমাকে নিয়ে তোমার খুব জ্বালা না?
বুড়ির কণ্ঠে ভিন্ন সুর। গফুর চমকে ওঠে।
–কে বললো?
–মাঝে মাঝে তুমি যে কেমন কথা বল?
গফুর হো-হো করে হেসে ওঠে। দমকা বাতাসের আচমকা ঘূর্ণি যেন।
–তোর জন্যে আমার মরে যেতেও সুখ রে বুড়ি?
পানির উপর ঝুঁকে পড়া তেঁতুল গাছের গোড়ায় নৌকা থামায় গফুর। নৌকা আটকানোর জন্যে লোহার শিকটা গেঁথে দেয় কাদায়। ডালপালার ঝোপঝাপে জায়গাটা চমৎকার। ঘরের নিরাপত্তা পাওয়া যায়। বুড়ির হঠাৎ করে ভালোলাগে।
–এখানে থামলে কেন?
–তোর জন্যে। গফুর বুড়িকে কাছে টেনে নেয়।
–জায়গাটা কি সুন্দর! মনে হয় ঘর।
–তোর ভালো লাগলেই হলো।
–আঃ কি কর! চারদিকে লোকজন।
–কোথায় লোক? এখনো পুরো আঁধার কাটেনি।
গফুর বুড়ির নিষেধ শোনে না। ভোরের হিমেল বাতাস ছুটে এসে গায়ে পড়ে। চমৎকার পরশ দিয়ে উধাও হয়ে যায়। তেঁতুলের ডাল গায়ের ওপর। শিরশির অনুভূতি জাগায়। যতদূর চোখ যায় সব ধােয়াটে দেখায়। বুড়ি অন্য কিছু ভাবতে চায় না। বুড়ি এখন নিজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। কখনো যে জিনিসটা কাথার ভেতর অসহ্য লাগে কখনো নৌকার উদোম হাওয়ায় তা অনবদ্য হয়ে ওঠে। কেননা যে ভালোলাগার রঙ এত ঘনঘন বদলায়! বুড়ি আপনমনে হেসে ওঠে।
–ছাড়ো।
–না। তুই বলেছিলি না বুকে নিয়ে ডুবে মরতে? এখন মরবো। সাধ হয়েছে মরার।
–ইস্ শখ কতো! আমি কি খালের পানি যে ডুবে মরবে?
–এখন তাই।
–তাহলে মর। আমি চোখ বুজলাম।
গফুর বড় নিঃশ্বাস নেয়।
–ইচ্ছে করে তোর ঠোঁটটা কামড়ে ছিঁড়ে নিই। বুড়ি আবার হেসে ওঠে।
মাছ মারতে এলে তুমি কামড়ে কামড়ে শালুক খাও। শালুক না খেলে না কি তোমার মাছ ধরার নেশা জমে না। তুমি শালুক দেখলে পাগল হয়ে ওঠ। আচ্ছা যখন শালুক থাকে না তখন তুমি কি খাও? তোমার নেশা কি দিয়ে আটকে রাখ?
–আঃ বুড়ি। বুড়ি-বুড়ি-বুড়ি–
গফুরের কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। গফুরের কণ্ঠ দিয়ে আর শব্দ বেরুতে চায় না। ও এখন কোনো শব্দ চায় না। চায় নীরবতা–প্রকৃতির মায়াময় নিস্তব্ধতা।
০২. বুড়িকে সঙ্গে আনলে
বুড়িকে সঙ্গে আনলে মাছ মারা আর হয়ে ওঠে না গফুরের। মাছ ধরার চাইতে বেশি হয় কথা আর তারও বেশি খুনসুটি। খলুই অর্ধেকও ভরে না। এমন দিনও গেছে যেদিন শুকনো জাল শুকনোই থাকে, জলে আর ভেজে না। খলুই গড়াগড়ি যায় পাটাতনে। সেদিন গফুর ঘরে ফেরে না। বুড়িকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে সোজা চলে যায় গঞ্জের হাটে। শূন্য খলুই দেখলে পড়শিরা হাসাহাসি করে। বুড়িকে বাঁকা কথা শোনায়। সেদিন বুড়ি চুপচাপ গিয়ে সলীম লীমের পাশে শুয়ে থাকে। যেন গফুর কোথায় গেছে ও তা জানে না। মাছ ধরতে না পারলেও গফুরের কোন ক্ষোভ থাকে না। বুড়িকে নিয়ে ডিঙি বাওয়াটাই মজা। আঁধার থাকতে বেরিয়ে যায়, আঁধার কাটার আগেই ফিরে আসে। তবু কখনো কারো কারো সামনে পড়ে যায়। দুচার কথা শুনলেও সেটা হজম করে নেয় গফুর। এ আনন্দ ওর জীবনে কোনদিন আসবে ও কি তা ভেবেছিল! জীবনের এ পরিবর্তন গফুরের কাছে পরম রমণীয় মনে হয়। মাছের খলুইয়ের শুকনো ভেজা হিসেব নিরর্থক হয়ে যায়। মনে হয় এদিন প্রতিদিন হোক। বুড়ি এমনি করে খুব কাছাকাছি এসে ধরা দিক। ঘরে বুড়ি শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। হদিস বের করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে গফুর। বুড়ি নির্বিকার। গফুরের কাছেও ঘেঁষে না। সলীম কলীমকে নিয়ে মাতামাতি করে। গফুর কৃত্রিম অভিযোগ করে, ছেলে দুটো তোকেই ভালোবাসে বেশি। আমাকে পর করে দিল।
–হিংসা কর?
–করিইতো। মাঝে মাঝে আমার সয় না। তুই জাদু জানিস বুড়ি।
–উঁহু মোটোই জাদু না। ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা মিলে।
–মিছা কথা। ভালোবাসা দিলেই কি আর ভালোবাসা মিলে? মনে হয় না। নইলে আমি হাপিত্যেস করি কেনো?
গফুরের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। কণ্ঠস্বরও।
–বাবা অতো কথা বুঝি না। আমার কাজ আছে যাই।
বুড়ি গফুরের সামনে থেকে সরে পড়ে। কাছে থাকলেই কোন না কোনভাবে ধরা দিতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও দিতে হবে। কিছুতেই যেন গফুরের আশ মেটে না। বুড়ি সলীম কলীমকে নিয়ে নাইতে চলে যায়। মন দিয়ে ঘরের কাজ করে। বিরোধহীন দিনগুলো নির্বিবাদে গড়ায়। গফুর হাল বায়, মাছ ধরে, হাটে যায়। বুড়ি ঘর সামলায়। কখনো ঠিকঠাক সব সামলে যায়, কখনো এলোমেলো হয়ে যায়। পাড়াপড়শি, আত্মীয় স্বজনের দুচারটে কথা শোনে–গালমন্দ খায়। ভাই বকাবকি করে। মা উপদেশ দেয়। তবুও ওসবের বাইরে বেহিসাবী কল্পনার রাশটা যখন আলগা হয়ে যায় তখন মন কেমন করে। নইলে নিজের মনের মধ্যে একটা নিপুণ সুখের খাঁচা বুনে নিয়েছে বুড়ি। নিতে বাধ্য হয়েছে। জানে এর বাইরে ওর কিছু করবার নেই। তাই পারিপার্শ্বিকের ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো, ওঠানামা, সমতল-অসমতল বিস্তার বুড়ি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু বাধ সাধলো প্রকৃতি। অনুভবটা বুড়ির নিজের মনের এবং সেটা বড় বেশি তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী। যে চপলতা, চাঞ্চল্য, বাইরের ডাক বুড়ির নাড়িতে সেই একই তীব্রতা ওকে ঠেলে নিয়ে যায় সন্তানের আকাক্সক্ষায়। বিবাহিত জীবনের তিন বৎসর ভালোই কেটেছে। চার বছর থেকে শুরু হলো বুড়ির দিন গোনার পালা। মাঝে মাঝে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ওর ঘৃণা হয়। এই শরীরটা কি মা হওয়ার উপযুক্ত নয়? কেননা শরীরের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করে না? কেনো কিছু একটা নড়ে ওঠার ধাক্কায় আচমকা চমকে ওঠে না? বুড়ির মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কারো কাছে খুলে বলতে পারে