বুড়ি দরজা ছেড়ে বারান্দায় নামে। সিড়ি বেয়ে উঠানে। রাত্রি প্রায় শেষ। আবছা আলো চারদিকে। পঁাচার ডাক থেমে গেছে অনেকক্ষণ। উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো বুড়িকে ঘিরে ধরেছে। কত কি যেন বলছে। বুড়ি কিছুই শুনতে পায় না। ওদের ভিড় সরিয়ে উঠানের শেষ মাথায় আসে। এবং পরক্ষণেই শুনতে পায় গুলির শব্দ। বুড়ি দৌড়ে বের হয়। কলীমের লাগানো জামরুল গাছের নিচে রইস রক্তের স্রোতে ভাসছে। ও বেড়া আঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে হয় বুকের ভেতরের পুলটা দুম করে ভেঙে পড়লো। রইস একটা টকটকে লাল তাজা বোমা। চারজন সৈনিক সদম্ভে মাটি কাঁপিয়ে ক্যাম্পের দিকে চলে যাচ্ছে।
যখন বাড়ির সবাই রইসের দিকে ছুটে গেল তখন বুড়ি আবার দৌড়ে ঘরে এলো। ধানের মটকার মুখ খুলে ওদের ডাকল। ওরা বেরিয়ে এলো। মনে আশংকা। শংকিত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকায়। বুঝতে পারে না কিছুই।
–ওরে তোরা পালা। ওরা চলে গেছে।
–চলে গেছে?
ওদের বিশ্বাস হয় না। নীতা বৈরাগিণীর উঁচুকণ্ঠের কান্না ভেসে আসছে।
–কাঁদে কে চাচি?
–তোদের এত কথার সময় নেই। তারা এখন পালা। তোদের তো আবার লড়তে হবে।
বুড়ির কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে ওঠে।
–আপনার জন্যে বেঁচে গেলাম চাচি।
–খালি কথা। যা এখন।
বুড়ি ওদের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে দেয়। বুকের ভেতর থেকে কান্নার ঢেউ পাহাড় সমান উঁচু হয়ে ছুটে আসছে। কিন্তু ওদের সামনে কিছুতেই তা প্রকাশ করবে না বুড়ি।
ওরা বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। দ্রুত বাইরে আসে। মৃত রইসকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। ওদের কোরবান চাচার কাছে সব শুনে বধির হয়ে যায় ওদের অনুভূতি। পায়ে পায়ে ফিরে আসে বুড়ির সামনে। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
–আপনার একটি মাত্র ছেলে। আমাদের জন্যে এ আপনি কি করলেন?
–তোদের যে আরো লড়তে হবে।
–তবু ওদের কান্না থামে না। বুড়ি ওদের হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধার চোখে পানি বেমানান।
–এখনও না পালালে তোরাও ধরা পড়বি। আর সময় নেই রে। তোরা যদি ধরা পড়িস বৃথাই রইস মরল। এক্ষুণি বেরিয়ে পড়।
বুড়ির কঠিন শাসনে ওরা আর দ্বিধা করে না। মনে হয় বুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ওদের নেই।
–মাগো যাই।
ওরা দুজন দৌড়ে বেরিয়ে যায়। বুড়ি বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। প্রবল কান্নার ধ্বনি আসছে জামরুল গাছের নিচ থেকে। সবাই কাঁদছে। বুড়ির বুক তোলপাড় করে ওঠে।
–তুই আমাকে একদিনও মা বলে ডাকিনি রইস। আমি জানি একটু পরে হলদী গাঁয়ের মাটি তোকে বুকে টেনে নেবে। তুই আর কোনদিন মা বলে ডাকবি না। আমিও আর অপেক্ষায় থাকব না। কৈশোরে, যৌবনে যে স্বপ্ন আমাকে তাড়িত করতো বার্ধক্যে যে স্বপ্ন আমি মুছে ফেলেছিলাম এখানেই তার শেষ। রইস তুই আমার কত আদরের কত ভালবাসার কত সাধনার ধন রে! তবু তোকে নিয়ে আমার বুকে কাঁটা ছিল। আজ আমি তোর রক্তে সে কাটা উপড়ে ফেললাম। তোর অপূর্ণতা–তোর অভাব আমি আমার জীবন দিয়ে শোধ করলাম। তুই মরে বেঁচে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্যে। রইস আমি তোর মা ডাক না শোনা মা। আমি কত নির্মম, নিষ্ঠুর হয়েছিলাম তা তুই বুঝতে পারিসনি। আমি তো জানি যে কটা দিন বাঁচবো তোর কষ্টে বুক পুড়িয়ে বাঁচবো। তবু এই কষ্ট থেকে আমি পার পেয়ে যাইরে যখন দেখি হলদী গাতো আমারই নিঃশ্বাসের। আমারই প্রতি রোমকূপের। আমি তখন আর সব কিছু ভুলে যাই। রইস তোর মাতৃত্বে আমার যে অহংকার–হলদী গাঁও আমার তেমন অহংকার। রইস তুই আমাকে মাফ করে দে। মাফ করে দে।
বুড়ি বেড়ার গায়ে মাথা ঠুকে ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে। নীতা এসে দাঁড়ায়।
–সই?
বুড়ির কান্না থামে না।
–সই চল, দেখবি না বুক পিঠ কেমন ঝাঁঝরা হয়েছে? রক্তে মাখামাখি হয়ে কেমন পদ্মের মত ফুটে আছে তোর রইস?
নীতার কথায় বুড়ি শক্ত হয়ে যায়। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
–হাঁ করে দেখছিস কি? চল। নাড়ি ছেঁড়া ধন চাই বলে পাগল হয়ে উঠেছিলি। তাকে আজ নিজ হাতে বলি দিয়ে কাকে তুষ্ট করলি সই?
বুড়ি কোন কথা বলে না।
নীতার প্রশ্নের উত্তর হয় না। বুড়ির ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া বুক এখন সমতল পলিমাটি। অনবরত বন্যায় ক্রমাগত উর্বরা হয়। খরায় নিরেট। তবুও শ্যামল খাল বিল নদী নালাময় বুড়ির বুকে আশ্চর্য পদ্মের সৌরভ।
–চল সই?
নীতা বুড়ির হাত ধরে নিয়ে আসে।
বুড়ি রইসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। জনযুদ্ধে উপেক্ষিত ছেলেটার উষ্ণ তাজা রক্ত হাত দিয়ে নেড়ে দেখে। রইসের ঠোঁটের কোণে লালা নেই। লালচে ক্ষীণ রেখা গড়াচ্ছে। রক্তের থোকায় কাত হয়ে পড়ে থাকা রইসের মাথাটা সোজা করে খুব আস্তে খোলা চোখের পাতা বুজিয়ে দেয় বুড়ি।
কারা যেন চারপাশে কথা বলছে। কেউ বুড়িকে গালাগালি করছে। ওর মনে হয় সলীম বুঝি ফিরে এসেছে। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বুড়ির আর কোন কিছুই মনে থাকে না।