গফুরের নৌকা অনেকদূর চলে এসেছে। বুড়ি হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপন ভাবনায় মগ্ন। মা-র কথা, ভাই-র কথা, পড়শিদের কথা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সরসরিয়ে আঁধার ঝরে যায়। ভোর রাতের হিমেল বাতাস যাদুকরি স্পর্শের মতো মায়াময় লাগে। পড়শিরা যারা ওকে উপদেশ দেয় তারা কি বুঝবে এর মর্ম। বুড়ির ভালোলাগা ধরার সাধ্যি ওদের নেই। এখন এই মুহূর্তে বুড়ির কেবলই মনে হয় এ ডিঙি যদি খাল পার হয়ে অনেকদূর চলে যেতো? যদি বড় গাঙের ডাক শোনা যেতো? এই দেশটার কোথায় কতো কি যে আছে বুড়ির কিছুই দেখা হলো না। দূরের কোনো কুটুম এলে বুড়ি মনোযোগ দিয়ে সে জায়গার কথা শোনে। শহর কি জানে না বুড়ি। সেখানের মানুষ কেমন তাও জানে না। কতো কি যে ওর জানার বাইরে রয়ে গেলো। বুড়ি এক বুক পিপাসা নিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। গফুরের ডিঙি তরতরিয়ে বয়ে যায়।
–তুই এতো কি ভাবিস বুড়ি?
–ভাবি? কি আবার ভাবি? ভাবনার কি শেষ আছে?
বুড়ির হাসি খানখান হয়ে ভেঙে গড়িয়ে যায় জলের বুকে। গফুর একটুক্ষণ থেমে সেই পুরোনো প্রশ্ন আওড়ায়; তোকে আমার বিয়ে করা ঠিক হয়নি বুড়ি?
–কেনো? এবার বুড়ি অবাক হয়।
–কেননা আবার, তোর সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক যে অনেক।
–তাতে কি, বয়সে কি হয়? ও নতুন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।
–এ জন্যেইতো তোকে বুঝি না। তোর ভাবনা ধরতে পারি না। হতাম তোর বয়সী তাহলে ঠিক হতো।
গফুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
বুড়ি ঠোঁট উল্টে বলে, বুঝে কি লাভ? যার যার ভাবনা তার তার কাছে। তুমি বুঝলেই বা আমার কি এসে গেলো? আমার অতশত ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার। ভাবনা কেউ বেশি বুঝতে চাইলে আমার রাগ হয়।
ও আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে। ওর অকারণ উচ্ছাস আজ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নিজেও তা রোধ করতে পারছে না। বুড়ির শরীরের ঝাকুনিতে নৌকার দুলুনি বেড়ে যায়! গফুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কখনোই ওকে বুঝতে পারে না। এমন বাধা-ভাঙ্গা হাসিও কদাচিৎ দেখা যায়। গফুর হাসতে হাসতে বলে, এতো হাসিস না বুড়ি? জানিস না যতো হাসি ততো কান্না।
–ছাই। তোমার যেমন কথা। হাসি পেলে হাসবো না বুঝি?
বুড়ির হাসি আর থামে না। গফুরও অকারণে হাসে, ছোঁয়াচে হাসি। জোরে জোরে বইঠা টানে। জলের কোলে নিবিড় সান্নিধ্য খোঁজে ডিঙি এবং সঙ্গে দুটি তৃষ্ণার্ত প্রাণও। গফুরের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বুড়ির মতো হয়ে যেতে। বুড়ির বয়সটা ফিরে পেলে গফুর পৃথিবীতে আর কিছুই চাইতো না। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মাছ ধরার জাল, ডিঙি নৌকা সব দিয়ে দিতে পারে ও। কোন দিনই হিসেবী লোক ছিল না। এখন বুড়ির সান্নিধ্য ওকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। ওকে একটু খুশি করতে পারলে বুক ভরে যায়। যখন বুড়ি মনমরা হয়ে থাকে, হাজার ডাকলেও সাড়া দেয় না, কথা বলতে চায় না তখন ভীষণ খারাপ লাগে গফুরের। কি করবে বুঝতে পারে না। ঘন ঘন হুঁকো টানা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। প্রথম স্ত্রীকে কেন্দ্র করে এমন কোন ইচ্ছেই গফুরের ছিল না। অথচ তখন দুজনেরই ভরা যৌবন। শারীরিক অনেক মাতাল ইচ্ছে ছিলো, সান্নিধ্যে ছিল উষ্ণতা, ছিল আমেজ। কিন্তু সে বৌ গফুরের চেতনা দখল করতে পারেনি। সে সময় গফুর মাঠে মাঠে বেশি সময় কাটিয়েছে। যাত্রা শুনে রাত কাবার করে ঘরে ফিরেছে। বৌ ওকে কিছু বলেনি। কোনো অনুযোগ করেনি। বরং প্রথম বৌয়ের ভয় ছিল বেশি। সব সময় আড়ষ্ট হয়ে থাকতো। সে সব নিয়ে গফুরের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। দুটো ছেলে হবার পর সম্পর্ক আরো শিথিল হয়ে যায়। গফুরের মনে হতো তখন কোনো বন্ধন ছিল না। কিন্তু এখন ও একটা বন্ধনের মধ্যে আছে। এই বন্ধন ওকে যতদূর টেনে নিয়ে যাবে ততদূর যেতেই ও রাজি। বুড়ি প্রাণবন্ত, সতেজ। সংসারের অনেক কিছুই বোঝে না। তবুও বুড়িকেই বেশি ভালো লাগে। গফুরের। ওর মধ্যে যেনো অতিরিক্ত কিছু আছে। কৈশোরের নোনাগন্ধে ভরপুর ওর। নতুন যৌবন। মিঠে নোনতা তেতো সব মিলিয়ে নতুন কিছু। ত্রিবিধ স্বাদ অথচ একটার সঙ্গে আর একটার অদ্ভুত যোগাযোগ। গফুর ঠিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। প্রথম যৌবনে গফুর এ স্বাদ পায়নি। তাই বুড়ির জন্যে সব সময় মন টানে। বুকটা চেপে থাকে। সারাক্ষণ একটা হারাই হারাই ভাব পাগল করে রাখে গফুরকে। মন বলে জলের টান কোনদিন বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ডিঙি বাইতে বাইতে গফুর বলে, আজ আর তোকে নিয়ে ঘরে ফিরবো নারে?
–কোনদিকে যাবে?
–যেদিকে দুচোখ যায়।
–বেশ যাও। এই আমি চোখ বুজলাম।
–ডিঙি যদি ডুবে যায়?
–তাতে কি, তুমি তো আছে।
বুড়ি পরম নিশ্চিন্তে খালের পানি গালে মাখে। দূরে তাকিয়ে থাকে।
–আমি যদি ডাঙায় ওঠাতে না পারি?
–বুকে নিয়ে ডুবে মরতে তো পারবে।
বুড়ি হেসে গড়িয়ে পড়ে। গফুর কথা বলতে পারে না। যুৎসই জবাব খুঁজে পায়। বুড়ির এ কথার পর আর উত্তর হয় না। গফুরের হঠাৎ মনে হয় এতটা বছর ধরে এ খালে ও নৌকা বাইছে তবুও কোথায় যেনো কি ওর দেখা হয়নি। বুড়ি সেসব নতুন করে দেখাচ্ছে। কখনো ইশারায় দেখায়, কখনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।
–হাঁ করে দেখো কি?
–দেখি তোকে।
–রোজই তো দেখো।
–তাও তো দেখা হয় না।
বুড়ি আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে।
–তুই অন্যরকম কেননা বুড়ি?
–কেমন?
–তা তো জানি না।
–তবে যে বললে?
–তাই তো? গফুর মাথা চুলকায়। কেমন তা কি ও নিজেও জানে? আসলে প্রকাশ করতে পারে না। প্রাণটা আইঢাই করে ফেটে গেলেও অনেক কথা বলতে পারে না।