বুড়ি নীতাকে ধরে ঝাকুনি দেয়।
–কি করি সই? কেমন করে ওদের বাঁচাব?
নীতা কথা বলে না। আঁচলে চোখ মোছে। বুড়ি রেগে যায়।
–তোর কেবল চোখে জল। সব হারিয়ে তুই শিখেছিস কাঁদতে? একটুও ভাল লাগে না।
বুড়ি ঘরে পায়চারি করে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারজন সৈনিক ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। সার্চ লাইটে আলোকিত করে ফেলে চারদিক। এত ঝকমকে আলো হলদী গাঁয়ের এই কঘর বাসিন্দা ওদের জীবনকালে দেখেনি। সৈনিকগুলো চিৎকারে বাড়ি মাথায় তোলে। ওরা বুঝতে পারছে না যে ছেলেগুলো কোনদিকে গেল? ঘরে ঢুকলো না বাশবন, সুপপারি বাগানে গিয়ে আশ্রয় নিল? ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করে। তারপর দুজন ঘরে ঘরে তল্লাসী শুরু করে। অন্যান্য ঘরের পুরুষদের উঠানে এনে দাঁড় করিয়েছে। বুড়ির হাত পা থরথর করে কাঁপে। বাঁশবনে চুপ করে বসে থাকা সাদা বকটার মত মনে হয় মৃত্যুর ছায়া। ঘরের বাইরে বাদাম গাছে পেঁচা ডাকে থেকে থেকে।
বুড়ি সারাঘরে পায়চারি করে। এক কোণে কুপি জ্বলে। রইসের মুখ থেকে কথা সরে গেছে। এত হট্টগোলেও ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি। ঘুমের মধ্যে গোঙায়। এটা ওর একটা অভ্যেস। বুড়ি ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর। হ্যাঁ, ঠিক সেই গন্ধ আসছে। কাদের হাফিজ যেদিন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছিল সেদিন ওদের শরীর থেকে যেরকম গন্ধ এসেছিল ঠিক সে রকম গন্ধ আসছে রইসের মুখ থেকে। চারদিক আলো করে কারা যেন বুড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ি দৈববাণী শুনতে পাচ্ছে। ফিসফিস করে বলছে, আর সময় নেই ! বুড়ির মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তই যেন ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ঘুমের ঘোরে রইস পাশ ফিরে শশায়। চকিতে একটা চিন্তা এসে বুড়িকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
নীতা দ্রুত বলে, সই আজ আমাদের সবাইকে মরতে হবে। বুড়ি ওর কথার উত্তর দেয় না। ওর কেবলই মনে হয় যে ছেলে জনযুদ্ধের অংশীদার হতে পারে না–যে ছেলে ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে না তার বেঁচে থেকে লাভ কি? কত হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। রইসও যদি যায়? না, পরক্ষণে মনটা মুষড়ে পড়ে। রইস ছাড়া বুড়ির পৃথিবী অন্ধকার। সব হারিয়ে কেমন করে বাঁচবে ও? পরক্ষণে সমস্ত হলদী গাঁ চোখের সামনে নড়ে ওঠে। বিরাট একটা ক্যানভাসে বুড়ির শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং সেই সঙ্গে নেংটি পরা মানুষগুলো উঠে আসে সামনে। ওদের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, আছে কেবল বুকভরা তেজ। তাই বুড়ির একার স্বার্থ ওখানে। সামান্য। বুড়ি চিন্তা ঝেড়ে ফেলে। ওদের কথাবার্তা শোনা যায়। বুঝি ওর ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। ও আর দেরী করে না। ঘুমন্ত রইসকে টেনে তুলে আনে বিছানা থেকে। চারদিকের এত আলোয় ও হকচকিয়ে যায়। বুড়ি লুকিয়ে রাখা এল.এম.জি, টা গুঁজে দেয় রইসের হাতে। রইস অবাক হয়ে একটুক্ষণ দেখে নতুন জিনিসটাকে। মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মাথা নাড়ে। এবং ভীষণ খুশিতে খেলনা ভেবে অস্ত্রটা জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ির সমস্ত শরীর কেঁপে যায়।
–নীতা তীব্র কণ্ঠে বলে, কি করছিস সই?
ও রইসের হাত থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিতে চায়। বুড়ি ক্ষিপ্রগতিতে সামনে এসে দাঁড়ায়, না। তুই ওটা নিতে পারবি না। ওটা রইসের বুকেই থাকুক ! আমি ওকেই দিয়েছি।
বুড়ির দৃষ্টি দপদপিয়ে ওঠে। চোখে জল নেই।
সৈনিক দুজন বুড়ির বারান্দায় ওঠার সময় পায় না। পা সিড়িতে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বুড়ি রইসকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দেয়। সৈনিক চারজন কলরব করে ওঠে। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ি। ওদের কিছুতেই ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেবে না। ঢুকতে হলে বুড়ির লাশ মাড়িয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু রইসকে পেয়ে সৈনিক চারজন আর অন্য কিছু ভাবে না। অত ভাবার ধৈর্য ওদের নেই। ওদের সোল্লাস মুখের দিকে তাকিয়ে ওর দম আটকে আসতে চায়। নিঃসীম বুকের প্রান্তরে হু হু বাতাস বয়ে যায়। বুড়ি হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারে না। ছুটে বেরুতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে। আরো দুটো প্রাণ ওর হাতের মুঠোয়। ও ইচ্ছে করলেই এখন সে প্রাণ দুটো উপেক্ষা করতে পারে না। বুড়ির সে অধিকার নেই। ওরা এখন হাজার হাজার কলীমের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওরা হলদী গাঁর স্বাধীনতার জন্যে নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে লড়ছে। ওরা আচমকা ফেটে যাওয়া শিমুলের উজ্জ্বল ধবধবে তুলল। বুড়ি এখন ইচ্ছে করলেই শুধু রইসের মা হতে পারে না। বুড়ি এখন শুধুমাত্র রইসের একলার মা নয়।
সৈনিক কজন তাদের নিজস্ব ভাষায় বুড়িকে ধন্যবাদ জানায়। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। দেশের জন্যে সত্যিকার কাজ করেছে বলে পুরস্কার দেবার কথাও বলে। বুড়ি এক অক্ষরও বুঝতে পারে না। নির্বাক পুতুলের মত দরজা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের হাতে বন্দী রইস কেবল নেড়েচেড়ে অস্ত্রটাই দেখে। কারো দিকে তাকাবার সময় ওর নেই। উঠানে দাঁড় করানো লোকগুলো সব থ। কারো মুখে কথা নেই। ওরা বুঝতে পারছে না যে কোথা দিয়ে কি হচ্ছে। হাবা-বোবা রইসের হাতে অস্ত্র দেখে কেউ প্রতিবাদও করে না। সব চুপ। ওরা কেবল অনুভব করে বুড়ির চোখ দুটো জ্বলছে। চোখের অমন আলো ওরা আর কোথাও দেখেনি। কোন সন্দেহের অবকাশ না রেখে রইসকে লুফে নিয়ে ওরা চলে যায়। আকাক্সিক্ষত শিকার এখন ওদের হাতের মুঠোয়। শিকার ঝলসানোর জন্যে ওরা এবার আগুন জ্বালবে। ওরা চলে যাচ্ছে। বুড়ি অনুভব করে ওর কলজেটা খাবলে নিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে।