পৌষের প্রথম রাতে গোলাগুলির ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওদের। বুড়ি গায়ের কাঁথা ছুড়ে ফেলে উঠে বসে। নীতাও গুটিসুটি উঠে আসে। ওর শরীর কাঁপে।
–কি হল সই?
–ঠিক আমাদের গাঁয়ের ক্যাম্পে আক্রমণ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।
–মাগো এখন কি হবে?
নীতা কাঁদতে শুরু করে।
–কি আর হবে, জঙ্গী ছেলেগুলো শীতের রাত গরম করে তুলেছে।
রইস কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওকে আর জাগায় না। বুড়ি বাঁশের ঝোপের কাছে এসে বসে। বুক দুরুদুরু করে, এত কাছ থেকে এমন শব্দ কি ও আর কখনো শুনেছে! শব্দ ক্রমাগত জোরালো হয়। আশপাশের ঘরের লোকজনের ফিসফাস কথাবার্তা শোনা যায়। সব ভয়ে আতংকগ্রস্ত। তটস্থ মেয়েরা ছেলে বুকে নিয়ে পালাচ্ছে। পুবদিকে সরে যাচ্ছে। অন্ধকার রাতে পথ চলায় একটুও অসুবিধে হয় না। বরং অন্ধকারই ভাল। চারদিকের এত আঁধারের মাঝেও বুড়ির বুকের ভেতর প্রদীপ জ্বলে। রমজান আলী এসে বুড়িকে ডাকে।
–ও রইসের মা?
–কি!
–এখনি পালানো দরকার।
–কেন?
–যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা সরে যাচ্ছি। যুদ্ধ থামলে ওরা আমাদের মেরে
ফেলবে।
–কি যে বল রমজান ভাই আমাদের ছেলেরা জিততেও তো পারে।
–জিতলে তো ভালই। না জিতলে? এখনই চল। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।
–আমার আর কি হবে? আমি যাব না।
–কি যে বল?
–না রমজান ভাই না। তুমি যাও। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। এই শীতের রাতে ওকে নিয়ে কোথায় যাব?
–মরণের শখ হয়েছে তোমার? তাড়াতাড়ি এস।
–না।
–যাবে না?
–না, রমজান ভাই। আপনি যান।
রমজান আলী রাগ করে চলে যায়। কলীমের মৃত্যুর কথা মনে হয় বুড়ির। ঘর থেকে উঠোনের ঐ জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। বুকটা কেঁপে ওঠে। গুলির শব্দ মানেই মৃত্যু। নীতাও তা জানে। তবুও বুড়ি চুপচাপ বসে থাকে।
–সই? নীতার কণ্ঠে বুড়ি চমকে ওঠে। ওর হাত চেপে ধরে।
–সই তুই ওদের সঙ্গে চলে যা। সত্যি যদি কিছু হয়?
–তোকে ছেড়ে আমি যাব? তুই কি করে বললি?
–তাহলে দুজনে বসে থাকি। দেখি শেষ কোথায়।
বুড়ি কান পেতে প্রাণ ভরে শব্দ শোনে। এমন শব্দময় উষ্ণ রাত বুড়ির জীবনে আর কোন দিন আসেনি।
কাদের আর হাফিজের নেতৃত্বে মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। প্রথমদিকে ওরা চমৎকার পজিশনে ছিল। অতর্কিত আক্রমণ বলে বেশ কয়েকটা মেরেও ফেলে। কিন্তু সংখ্যায় কম ছিল বলে ওরা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। তার ওপর ওদের গুলিও ফুরিয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে ওরা পালাবার চেষ্টা করে। অন্ধকারে এক একজন এক একদিকে দৌড়ায়। কাদের হাফিজ গাঁয়ের পথ চেনে। চেনা পথে ওদের অসুবিধা হয় না। শুধু এলোমেলো পথ ঘাটে কখনো পা বেঁকে যায়। ওদের পেছনে ধাওয়া করে চারজন মিলিটারি। পেছন থেকে ওরা গুলি ছোড়ে। কানের পাশ দিয়ে আগুনের ফুলকি হলকা ছড়িয়ে যায়। কাদের আর হাফিজ প্রাণপণে ছুটছে। সৈনিকদের দৃষ্টি এড়াতে ওরা সোজা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে যায়।
উঠানে দুপদাপ্ শব্দ। দুলে ওঠে বুড়ির বুক। ওরা কি তবে পালিয়ে এল? যুদ্ধ কি শেষ? গুলির শব্দ আর তেমন জোরালো নয়। ফাঁকা আওয়াজ ভেসে যায় শূন্যে। পাল্টা জবাব আর গর্জে ওঠে না। বুড়ির বুক খালি হয়ে যায়। ওরা কি তবে হেরে গেল? ও নীতার হাত চেপে ধরে।
–সই ওরা কি হেরে গেলো? ওরা হারতে পারে না। আমার বিশ্বাস হয় না।
বুড়ি ফুঁপিয়ে ওঠে। নীতার হাঁটু কাঁপে থর থর করে। বারান্দায় উঠে এল ওরা। বুঝি ঝাপের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
–চাচি?
বুড়ির বুক কাঁপে। কে ওরা? চেনা ছেলে মনে হয়?
–চাচি দরজা খোলেন।
অস্থির কণ্ঠ। এক মুহূর্ত দেরি সইছে না। বুড়ি তৈরি হয়ে যায়। হ্যাঁ, এখনই প্রকৃত সময়। ওরাই এসেছে। সেই বীর যোদ্ধা ছেলেগুলো। ওরা আশ্রয় চাইছে। ওরা প্রার্থনার ভঙ্গিতে নিরাপত্তার আশ্বাস চাইছে। ওদের আশ্রয় দেয়া দরকার। একবার পালিয়ে এসেছে তাতে কি হয়েছে? ওরা আবার নতুন করে যুদ্ধে নামবে। শক্তিমান ঈশ্বরের মত মনে হয় নিজেকে। বুড়ি দরজা খুলে দেয়।
কাদের আর হাফিজ হুড়মুড়িয়ে ঢোকে।
–ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে চাচি। তাড়া করে আসছে। বাবা মা কে তো পেলাম না। আপনি আমাদের আশ্রয় দেন চাচি।
মিনতিতে ভেঙে পড়ে কণ্ঠ। বুড়ি জানে না প্রার্থনার ভঙ্গি এমনি কি না। এত কিছুর প্রয়োজন ছিল না। ওরা যদি বুক টান করে বলতো, আমাদের বাঁচাও। তাতেই বুড়ি বিগলিত হয়ে যেত। বুড়ি জানে ওদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। হলদী গাঁয়ের প্রাণ এখন ওদের হাতের মুঠোয়। ওদের বাঁচাটা মাটির মত প্রয়োজন। বুড়ি কর্তব্য ঠিক করে নেয়। ওদের টেনে নিয়ে যায় ঘরের কোণে। খালি হয়ে পড়ে থাকা বড় মটকার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। মুখে ঢাকনা দেয়। ঢাকনার ওপর টুকরি। টুকরির ওপর পুরোনো কাপড়ের পুঁটলি।
নীতা হাঁ করে দেখে কেবল। বুড়ি ফিরে এলে ডাকে, সই! বুড়ি পরিতৃপ্তির হাসি হাসে।
–ওদের না বাঁচালে আমাদের জন্যে লড়বে কে?
বুড়ি আবার ঝাপের কাছে বসে। রমজান আলী ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তবে সবাই যায়নি। বুড়ির মত আরো কেউ কেউ রয়ে গেছে। একবার মার খেয়ে রমজান আলীর সাহস কমে গেছে। ওর কথা শুনে বুড়িও যদি পালাতো তবে কে ওদের আশ্রয় দিত? বুড়ি জানে এই কঘর বাসিন্দার মধ্যে আর কারো এত সাহস হতো না। গর্বে, ভয়ে, আশংকায়, আনন্দে বুড়ির বুক ওঠানামা করে। এখন কি করবে? ওরা যদি খোজ করতে আসে? আসে নয় আসবেই। বুড়ির মনে হয় বিশাল অরণ্যে ও একা। চারদিক থেকে নেকড়ের দল বন-জঙ্গল ভেঙে ছুটে আসছে আক্রমণ করতে। শিউরে ওঠে বুড়ি। কিছুই ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কি করা উচিত? পথ আগলে দাঁড়াবে? বলবে, আগে আমাকে মার তারপর ঘরে ঢোকো? কিন্তু তাতে লাভ? ছেলে দুটো কি তাতে বাচবে? বুড়ির মৃত্যুর বিনিময়ে তো ওরা বাঁচবে না? কি করবে? কি করা দরকার? মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে। ওর ওপর নির্ভর করছে ওদের জীবন-মৃত্যু। ওদের বেঁচে থাকা একান্তই দরকার।