–জুটলো কৈ? একা একা থাকি তো তাই আমিই কটা দিন রেখে দিলাম। ও তো রোজই চলে যেতে চায়। বুড়ো মানুষ আমারই বা ভরসা কি বল?
–না বাপু ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় কর নইলে তোমারই আবার বিপদ হবে।
বুড়ি হি হি করে হেসে ওঠে।
–বিপদের আর বাকী কি? সংসার আমার মানুষ-শূন্য হয়ে গেল। উড়ো খবর পাই সলীমও নাকি যুদ্ধে মরেছে।
–তাই নাকি?
মনসুর লাফ দিয়ে বুড়ির কাছে সরে আসে।
–তা খবরটা কার কাছে পেলে।
–এ ও বলে। বুড়ি চোখে আঁচল চাপা দেয়।
–আহা কেঁদ না রইসের মা। বড় দুঃখের কপাল তোমার। নিজের ছেলেটাও হল হাবা আর বোবা। কোন কাজেই এলো না। যাক দুঃখ করো না। আমরা তো আছি। দরকার হলে খবর দিও। তবে হ্যাঁ ঐ বোষ্টমীটাকে আজই বিদায় কর।
–তা আর বলতে।
–যাই মেলা কাজ। সাবধানে থেক রইসের মা। মনসুর ছাতা মাথায় মেঠো পথে নেমে যায়। একটু পর ঘুরে আসে আবার।
–হ্যাঁ গো রইসের মা সলীমের খবরটা সত্যি তো?
–লোকে তো বলে। নিজের চোখে তো আর দেখিনি।
–তা তো ঠিকই। ওদের নিয়ে তোমারও আদিখ্যেতা আছে বাপু। তা আমি বলি। সতাই ছেলে দুটো গেছে তোমার ভালই হয়েছে। সম্পত্তি সব এখন তোমার রইসের। কি খুশি লাগছে না?
বুড়ির দম আটকে আসে। শক্ত হয়ে যায় শরীর।
–বুঝলে খুশিটা আমারও। যাই সলীমের খবরটা পৌছে দেই ক্যাম্পে।
মনসুর হনহনিয়ে হেঁটে যায়। বুড়ি থু করে একদলা থুতু ফেলে। ওর সঙ্গে কথা বলতেও শরীর কেমন ঘিনঘিন করে। শকুন! শকুন একটা। বুড়ি অকারণে কাটা ঝোপে লাথি মারে। সলীম ফিরে এলে তোর হাড়-মাংস চিবিয়ে খাবে। তোকে কুকুরের মুখে, শিয়ালের মুখে তুলে দেব আমি। উঃ সলীমের খবরটায় কেমন লাফিয়ে উঠলো শূয়োরটা। মাগো মাথা আমার খারাপ হয়ে যাবে। মিথ্যে বানিয়ে বলে ওকে ধোকা দিয়ে এখন নিজের বুকের মধ্যে কেমন ছটফট করছে। সলীম আমি তোকে পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু তবুও তোর মা হয়ে বলছি আমার মুখে ঝাটা পড়ুক। তোর শত বছর পরমায়ু হবে রে। সলীম বিশ্বাস কর ও যাতে আমাকে আর নীতাকে না ঘটায় সেজন্য মিথ্যে বলেছি। বুড়ির অস্বস্তি তবু কাটে না। কেন এমন হঠাৎ করে সলীমের মৃত্যুর খবর মনে এল? সলীম তোর যুদ্ধের দোহাই, তোর মুক্তিযোদ্ধাদের দোহাই আমার মনে একটুও পাপ নেই রে। আমি সম্পত্তি দিয়ে কি করবো, ঐসব আমার চাই না। এ বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে ঘরে ফিরে। বিড়বিড় করতে করতে ভাত চড়ায়। সারাদিন বুড়ি আচ্ছন্নের ঘোরে কাটিয়ে দেয়। নীতার সঙ্গেও কথা বলতে পারে না।
–তোর কি হয়েছে সই?
–আমি রটিয়ে দিয়েছি সলীম যুদ্ধে মরেছে। বুড়ি অবিচল কণ্ঠে বলে।
–কেন এমন করলি?
–সলীম মরে গেলে ওরা খুশি হবে। তাহলে আমাকে আর বেশি ঘটাবে না। তোর এখানে থাকা নিয়ে কথা বলবে না। জানিস নীতা এখন ঐ সৈনিকগুলোর চাইতে আমি মনসুরকে বেশি ভয় পাই রে। ও আমার ঘরের কাছের লোক। ও আমার হাঁড়ির খবর রাখে।
বুড়ি সারাদিনের পর এতক্ষণে কেঁদে ফেলে। নীতা বুড়ির মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। বুড়িকে বুঝতে পারে না। ওর মুখের রেখা পড়তে পারে না। বুড়ি এখন নীতার কাছে অচেনা এক মেয়েমানুষ।
বুড়ির রটনা বাতাসের বেগে সারা গায়ে ছড়িয়ে যায়। মনসুর পথে পথে যাকে পেয়েছে তাকেই সোল্লাসে খবর দিয়েছে। যারা সলীমের বিজয়ীর বেশে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে তারা চুপি চুপি বুড়ির কাছে আসে।
–খবরটা কি সত্যি রইসের মা?
–হ্যাঁ। বুড়ি গলা না কাঁপিয়ে উত্তর দেয়।
–খবরটা আনল কে?
–একটা ছেলে। চিনি না। রমজান আলী শুনে গর্জে ওঠে।
–মিথ্যে কথা। নিশ্চয় সলীম মরেনি। এটা ঐ মনসুরটার বানানো কথা।
বুড়ি রমজান আলীর প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ওর কণ্ঠের গর্জনে স্বস্তি পায়। সে কণ্ঠ বুকের ভেতর ধরে রাখে। ঘরের ভেতর থেকে নীতা অনবরত চোখের জল মোছে। মনে হয় বুড়ির কাছাকাছি পৌছার সাধ্য এখন আর ওর নেই।
এইসব টানাপোড়েনে দিন কেটে যায়। বুড়ির বুকের দিগন্ত অনবরত প্রসারিত হয়। হলদী গায়ের সীমানা পেরিয়ে যায়। গুলির শব্দের জন্যে কান খাড়া করে রাখে। কখনো রমজান আলী ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি কথা বলনা কেন রইসের মা? সলীমের খবরটা কি তোমার কাছে বাতাসে ভেসে এল? তোমার কাছে কে এসে খবর দিয়ে গেল আর আমরা কিছুই জানলাম না এটা হয় নাকি?
বুড়ি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। রেগে যায় রমজান আলী।
–তোমাকে যে কোন ভূতে পেয়েছে আল্লাহই জানে?
বুড়ি রমজান আলীর দুপদাপ পা ফেলে চলে যাওয়া দেখে। দেখতে ভাল লাগে। বিড়বিড় করে, চারদিকে এমন দুপদাপ শব্দই তো আমি চাই। বুড়ি অনুভব করে বুকের সীমানায় গলগলিয়ে জনস্রোত ঢুকছে। ওর ভাবনার মাঠঘাট প্রান্তর স্বর্ণপ্রসবিনী করে তুলছে। বুড়ির পলিমাটি চেতনায় রাশি রাশি শস্যের কণা।
শুধু বাঁশবনে বা খালের ধারে দাঁড়িয়ে মনসুর যখন বিগলিত হেসে গদগদ স্বরে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ রইসের মা? তখন বুড়ির পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণার চাবুক লিকলিকিয়ে ওঠে। ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। একদলা থুতু ফেলে। মনসুর সহানুভূতি জানায়, আহা তোমার কি এখন মাথার ঠিক আছে? সতাই ছেলে হলেও তুমিই তো কোলেপিঠে করে মানুষ করেছ।
বুড়ি কথা শেষ করার আগেই হাঁটতে শুরু করে।
–ও রইসের মা? রইসের মা?
মনসুর জবাব না পেয়ে ফিরে যায়। বুড়ি গরুর খুঁটি আলগা করে বাঁশের কঞ্চি কুড়িয়ে বুনো লতায় সপাং সপাং পিটায়। বুড়ির শরীরের র-র দপদপানি কমে না।