গান? হো হো করে হেসে উঠেছিল ছোড়াগুলো। বিশ্বাস কর সই ন্যাংটা অবস্থা থেকে ওদের আমি বড় হতে দেখেছি। যুদ্ধ লাগার আগেও ওরা আমাদের আখড়ায় আসতো গান শুনতে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, গান লিখেছো বাছাধন, ঘুঘু দেখনি, এইবার দেখ, এই নাও গান লেখার পুরস্কার!
–দুম করে মেরে দিল। লুটিয়ে পড়ল অখিল বাউল আর বাকিরা। কেউ আর কথা কইতে পারলো না। আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই দুঘা দিয়ে ফেলে দিল। সুষমা, মালা, চন্দনা আর রাধাকে নিয়ে গেল।
ওরা চিৎকার করছিল। শুনলো না। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। বুড়ো মানুষ ওদের সঙ্গে পারব কেন?
–কেবল বলতে ইচ্ছে করছিল, ওরে কতদিন রাত জেগে তোরা আমাদের গান শুনেছিস। বলেছিস, তোমাদের গানের গলা বড় মিঠে গো। বলেছিস, তোমাদের এই জায়গাটা বড্ড শীতল। মনে হয় দিনরাত শুয়ে থেকে কাটিয়ে দি। ওরে তোরা এখন বলে যা আজ কি করে আমরা দেশের শত্রু হলাম। একথা তো তোরা আগে একদিনও বলিসনি? ওরা চলে যেতে বুকটা আমার পাথর হয়ে গেল সই। সব লাশগুলো টেনে টেনে নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। ঘরের আগুন তখনো নেভেনি। জ্বলছিল ধিকিধিকি। আমি গাছের নিচে দুরাত কাটালাম। তারপর তোর কথা মনে হলো। শুরু হলো বৃষ্টি। মানলাম না। বৃষ্টি মাথায় করে চলে এলাম। বড়ড শীত করছে রে সই।
–চল কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বি।
সেই শোয়াতে পনের দিন কাটিয়ে দিল নীতা। জ্বরে গা যেন পুড়ে যায়। বুড়ি কি করবে দিশে পায় না। গাঁয়ের কবরেজ ডেকে ওষুধ দেয়। মাথায় পানি ঢালে। বেহুশ অবস্থা নীতার। যমে মানুষে টানাটানির পর পনের দিনের মাথায় জ্বর ছাড়ে। দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সই আমার কি হয়েছিল?
–জ্বর।
বুড়ি হেসে ফেলে।
–হাসছিস কেন? তোর এখানে কদিন কাটালাম রে?
–এই তো দিন পনের।
–দিন পনেরো? নীতা অনেক কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মাথা আবার এলিয়ে দেয়। বুড়ি সাগু গরম করে এনে খাওয়ায় ধরে বারান্দায় বসিয়ে দেয়। নীতা হলুদ নিপ্ৰভ দৃষ্টি মেলে আকাশ দেখে। গাছ-গাছালির মাথার ওপর সূর্যের আলো দেখে। কণ্ঠে গান গুনগুনিয়ে উঠতে চায়। দমে কুলোয় না। বুড়ি এসে পাশে বসে। নীতার জন্যে ও পুকুর থেকে শিং মাছ ধরিয়েছে। থানকুনি পাতা দিয়ে তার ঝোল বেঁধেছে। আজ ওকে ভাত দেবে। বুড়ির মন বেজায় খুশি। নীতাকে ও বাঁচাতে পেরেছে।
–আজ তোকে ভাত দেব সই।
–ভাত খেতে ইচ্ছে করে না।
–ইচ্ছে না করলে কেমন হবে? গায়ে বল করতে হবে না?
–আর বল? নীতা ফিকে হাসে। আমার সব বল ওরা কেড়ে নিয়েছে।
–বাজে কথা। তুই আবার বেঁচে উঠেছিস সই। এ কটা দিন যে কেমন করে কেটেছে একমাত্র আল্লাহ জানে।
–তোর খুব কষ্ট হয়েছে না রে?
–ধুত কি যে বলিস? নীতা চুপ করে থাকে।
–আমার দোতারাটা পুড়ে গেছে। অখিলেরটা ও বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ছোঁড়াগুলো পায়ে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলেছে।
নীতা যেন আপন মনেই কথা বলে।
–যারা আমাদের গান ভালবাসতো তারা আমাদের শত্রু বলে কেন? আমরা কোন অপরাধে শত্রু হলাম? আমাদের মেয়েগুলোকে নিয়ে যেতে ওদের একটুও বাধলো না! এই বুঝি ওদের দেশপ্রেম?
–তুই কেবল ওদের কথা ভাবছিস কেন সই? ওদের মত আমাদের আরো অনেক ছেলে আছে যারা যুদ্ধ করছে?
–যুদ্ধ? সই দেখিস দেশ একদিন স্বাধীন হবে।
নীতা আবেগে উত্তেজনায় বুড়ির হাত চেপে ধরে।
–তোর ছেলে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু তখন আমি কোথায় যাব? আমার ঘর নাই, মানুষ নাই, কেউ নাই। এই হলদী গা ছেড়ে আমার কোথাও যেতে মন চায় না রে সই।
–এখন এসব কথা থাক। তুই আগে সুস্থ হয়ে নে।
–তোর ছেলে ফিরে এলে ওকে বলবি গাঁয়ের মাথায় আমাকে একটা চালা তুলে দিতে। যে কটা দিন বাচি ভিক্ষে করে দিন কাটিয়ে দেব। এই গা ছেড়ে অন্য আখড়ায় আমি যাব না রে সই।
নীতা হু হু করে কেঁদে ফেলে।
–এখন তুই আমার কাছে থাকবি। আমি একলা একলা থাকি তোকে পেয়ে আমার কি যে ভরসা হচ্ছে। তোকে আমি ছাড়ছি না।
–শরীরের যা অবস্থা! হাঁটতেই তো পারি না। যাব আর কোন চুলোয়।
নীতা অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলে।
–যাই তোর ভাত নিয়ে আসি।
বুড়ি নীতার কান্না দেখতে চায় না। ওর সামনে থেকে উঠে পড়ে। নীতা জ্বরের ঘোরে বলতো, আমরা পথঘাটের মানুষ। ঘরের মায়া নেই। তবু বুকটা এমন হু হু করে পোড়ে কেন বলতো সই? শান্তি কমিটির নামে ওরা কত জাত ভায়েদের মারলো, ঘর পোড়ালো, মা বোনের সম্ভ্রম নিলো–ওরা এই মাটির শত্রু নয়, হলাম আমরা।
বুড়ি ভাত বাড়তে গিয়ে থমকে যায়। নীতার সব গেছে তাতে ওর দুঃখ নেই। ওর বুক খা হয়ে যাচ্ছে আলী আহমদের ঐ একটা কথায়। ঐ কথায় ওর সারা জীবনের ভিত নড়ে উঠেছে। অথচ দুঃখ নেই আলী আহমদের। ওরা নির্বিবাদে দেশের শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। রইস এসে রান্নাঘরে ঢোকে। ইশারায় ক্ষিধের কথা বলে। বুড়ি তাড়াতাড়ি কাঠের চামচ দিয়ে ভাত ওঠায়।
নীতা এখন একদম ঘর থেকে বের হয় না। একদিকে ভয় অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতা। গুলি, মৃত্যু, আগুন নীতার সব সাহস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ওর কণ্ঠের গান এখন বুড়ির ঘরের দেয়াল পেরোয় না। মুখে হাসি নেই। নীতা স্থবির হয়ে গেছে।
–তুই এমন ভেঙে পড়লি কেন সই?
–এত মৃত্যু আমি কখন দেখিনি রে। নীতা আনমনা হয়ে বলে।
–আমিও কি দেখেছিলাম।
বুড়ির কণ্ঠও খাদে নেমে যায়। তবু ওর সঙ্গেই দুচারটে কথা বলে বুড়ির সময় ভালই কাটে। মনসুর একদিন বাঁশবাগানে বুড়ির পথ আগলে দাঁড়ায়, কি গো রইসের মা বৈরাগিণীটা নাকি তোমার এখানে এসে জুটেছে?