রমিজা খবর পাঠিয়েছে। ওরা ভাল আছে। ছেলেটা খুব হাশিখুশি হয়েছে। কান্নাকাটি নেই। সারাদিন ধুলোয় খেলে। কথা বলার চেষ্টা করে। রমিজা অনেক পিঠে দিয়েছে বুড়ির জন্যে। মাছ পাঠিয়েছে, ডিম পাঠিয়েছে। কিন্তু পিঠে কে খাবে? পিঠে পাগল সলীম তো আর নেই। প্রতিদিন এক একরকম পিঠে তৈরি হত সলীমের জন্যে। পিঠে না হলে ও রমিজাকে বকাবকি করত। বুড়িকেও ছাড়ত না। সলীম এখন যুদ্ধ করছে। পিঠে খাওয়ার কথা এখন আর ওর মনে নেই। বিরাট সুখের প্রত্যাশায় ওরা। ছোটখাটো সব সুখের কথা ভুলে গেছে। বুড়ির মনে হল রমিজা কি সলীমকে মনে করে এত পিঠে পাঠিয়েছে? বেচারী! কোন খবরই পাচ্ছে না সলীমের। ও হয়ত ভাবছে, কোনদিন রাতের অন্ধকারে সলীম যদি চুপিচুপি ঘরে ফেরে? এখানে থাকতে রমিজা এই প্রত্যাশা করতো। এখানে থাকলে তবু ওর ভাল হতো। না হয়ত খুব ভাল হত না। কিইবা ভাল হতো। এখানে ঐ লালমুখো সৈনিকগুলো যেমন উৎপাত করে! কত লোক সরে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে। দক্ষিণের প্রত্যন্ত সীমানায়। বুড়ির বাড়ি থেকে সিকি মাইলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প। ওরা যখন যা খুশি তা করে। হুটপুট করে এসে হাঁস মুরগি-গরু-ছাগল যেমন নিয়ে যায়, তেমন ডবকা মেয়েরাও যায় রশি বেঁধে টেনে নেয়া ছাগলের মত চেঁচাতে চেঁচাতে। বুড়ি এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে রমিজা দূরে আছে ভালই আছে। কলীমের মৃত্যু সহ্য হয়েছে। কিন্তু চোখের সামনে রমিজার কোন দুর্ঘটনা সইবে না। ও ভাল থাকুক। ভাল।
কার্তিকের হিম হিম ভাব আর নেই। ফিনফিনে নীল কুয়াশা গাঢ় হয়েছে। অঘ্রাণের শেষ। আর দুএকদিন বাকি। জোর শীতের দাপট চারদিকে। মাচানের ওপরের ঝাঁকঝাঁক বেগুনি ফুল সবুজ শিম হয়ে গেছে। মাছরাঙার শরীর চর্চ করে। টুনটুনি উড়ে বেড়ায়। দেখতে ভাল লাগে। দেখতে দেখতে মনে হয় সবসময় শীতকালে রইসের শরীর ভাল হয়। এবারও বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। মুখটা ভরা পুকুরের মত টলটলে। টানা বড় বড় চোখ জোড়া লাল শাপলার পাপড়ির মত। ও বেশ ছটফটে হয়েছে। ঝিম-ধরা ভাব নেই। ওকে দেখে বুড়ির দিন মুখর হয়ে ওঠে। বুকের দীঘি থৈ থৈ আনন্দে বেসামাল হয়। ওর পরিবর্তন মনে করিয়ে দেয় যে ওর মধ্যেও একটা মুখর প্রাণ আছে। কিন্তু আসলে ওর কোন ভাষা নেই। শীতে ও প্রাণের জোয়ারে প্লাবিত হয়। বাহ্যিক আচরণে তা জানান দেয়। ও আরো দামাল হোক, চঞ্চল হয়ে উঠুক। বুড়ি সারাক্ষণ এই প্রার্থনা করে। রাত্রিবেলা ওর পাশে শুয়ে থেকে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলে। কখনো নিজের জীবনের গল্প করে। রইস ঘুমিয়ে গেলেও বুড়ি বলতে থাকে। বলতে একটুও ক্লান্তি নেই। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অঘ্রাণের কুয়াশার মত খুশির ফিনফিনে নীল পর্দা হয়ে থাকে মনটা।
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। একদম আষাঢ়ে বৃষ্টির মত একটানা। ঘনকালো মেঘ আকাশে। চারদিক অন্ধকার করে নেমেছে। রইস উঠে পান্তা খেয়ে আবার শুয়েছে। বুড়ি ভিজে ভিজে হাঁস-মুরগির খোয়াড় খুলেছে। গোয়াল পরিষ্কার করেছে। গরুকে খড়-ভূষি দিয়েছে। আর এসব করতে করতে বুড়ির মনে অনেকদিনের পুরোনো এক গান বারবার গুনগুনিয়ে উঠছে। বুড়ির যে প্রচণ্ড শীত করছে একথা একবারও মনে হয় না। মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে আঁচলটা নিংড়াতে নিংড়াতে বুড়ি যখন বারান্দায় উঠে আসে তখন নীতা বৈরাগিণী ঢোকে। বুড়ি বিস্ময়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, সই?
নীতা কথা বলে না। ভিজে শরীর নিয়ে বারান্দার ওপর উঠে আসে।
–এমন ঝড়-বাদল মাথায় করে কোথা থেকে এলি?
নীতা কথা বলে না। দুহাতে মুখ ঢাকে।
–তুই কাঁদছিস সই? ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আগে কাপড় ছেড়ে নে?
নীতার পোটলাটা আজ ওর সঙ্গে নেই। বুড়ি ঘর থেকে শুকনো কাপড় এনে দেয়।
–নে ভিজে কাপড় ছাড় আগে, তারপর তোর সব কথা শুনব। আজ আমার মন খুশি খুশি, তোকে পেয়ে আরো ভাল লাগছে। বৃষ্টি ভরা এই দিনটা দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দেব। কতদিন যে মন খুলে কথা বলার মানুষ পাইনি।
নীতা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে হি হি করে কাঁপে। অনেকটা পথ ভিজতে ভিজতে এসেছে। ঠাণ্ডা ওর হাডিড়র গায়ে লেগেছে। বুড়ি মালসায় করে কয়লা ধরিয়ে আনে।
–হাত-পা গুলো সেঁকে নে সই।
–আগে আমাকে ভাত দে। দুদিন ধরে মুড়ি আর জল ছাড়া কিছুই খাইনি।
–পান্তা আছে মরিচ পুড়িয়েছি। আগুন পোহাতে পোহাতে খাবি চল।
দুজনে ভাত খায়। নীতার কিছু একটা হয়েছে বুড়ি তা বোঝে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারে না। ভয় হয়। এমন কিছু হয়তো শুনবে যে বুড়ির মন ভার হয়ে যাবে। সারাটা দিন খারাপ লাগবে।
–তোর এখানে আমি দুটো দিন থাকব সই।
–কি ভাগ্যি! আগে তো মোটেও রাখতে পারিনি।
নীতার চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
–তুই থাকলে আমার ভালই লাগবে। একা একা আর দিন কাটে না।
বুড়ি খেয়েদেয়ে চিকন সুপপারি কাটে। অনেকদিন পর ও চিকন সুপোরি কাটতে বসেছে। নীতা মালসার ওপর হাত পা গরম করে।
–বৃষ্টি তো নয় একদম হাড়-কাঁপানো সুচ।
বুড়ি অন্যমনস্কর মত বলে, তোর অখিল বাউল কৈ সই?
–মরেছে।
–কি হয়েছিল?
–বুকে গুলি খেয়েছিল।
–সই!
বুড়ি আঁৎকে ওঠে।
আমার আখড়া আর নাইরে সই, যেখানে আমি ফিরতে পারি। সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
বুড়ি স্তব্ধ হয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। সুপোরি কাটাও হয় না। নীতা চোখে আঁচল চাপা দিয়েছে।
–কেন যে আমাদের আখড়া পুড়িয়ে দেয়া হলো, লোকগুলোকে গুলি করা হলো, বাকিদের ধরে নিয়ে গেল তার আমি কিছুই বুঝি না সই। তবু যদি ঐ ভিনদেশী কুত্তাগুলা করতো তাও প্রাণে সইতে। করেছে সব আমাদের জাত ভায়েরা। যাদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা চলাফেরা; এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি সই? অখিল বাউল মরেছে সেই দুঃখের চাইতেও বেশি বাধে যে ওকে গুলি করেছে আলী আহমদ। কিসে যেন বুকটা কামড়ে ধরে। কারো সঙ্গে কথা কইতে পারি না। যারা এমন কাজ করলো ওদের সবাইকে আমরা চিনি। আমাদের মুখের ওপর থুতু দিয়ে বলেছিল, আমরা নাকি দেশের শত্রু। এই শুনে অখিল বাউল গর্জে উঠেছিল, মিথ্যে কথা। মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। দেশের জন্যে গান লিখেছি।