মাঝে মাঝে গুলির শব্দে বুড়ির অসহ্য নীরবতা চনমনে ভরপুর হয়ে ওঠে। জল ছুপছুপ নদীর মত মনে হয় নিজেকে। যে নদী কানায় কানায় ভরা। যে নদীর মাঝে কোন চর পড়েনি। বাঁশবনের মাথার উপর দিয়ে সাদা বক উড়ে যায়। শরতের আকাশ উজ্জ্বল নীল। বুড়ি খালের ধারে যায়। খালপাড়ের সাদা কাশফুল দেখে। কাশফুল তুলোর মত ধবধবে নয়। ওর মধ্যে অন্য রঙের আভা আছে। মনে হয় তুলোই ভালো। শিমুলের ডালে কিচির-মিচির করে চড়ইয়ের ঝাঁক। কখনো খাকী পোশাক-পরা লোকগুলো রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। বুড়ির আর ভয় করে না। ওরাও ওকে কিছু বলে না। বুড়ি ভাবে, ওরা ওকে আমল দেয় না। ওদের শত্রুর মধ্যেই গণ্য করে না। বুড়ি ডিমার শাক খুটতে খুঁটতে হাসে। ওরা বুঝতে পারে না বুড়ি বুকের মধ্যে কি বিরাট এক আগুনের পিণ্ড সাজিয়ে রেখেছে। মুহূর্তে ওটা দপ করে জ্বলে উঠতে পারে। ভিনদেশী দানবগুলো কখনো দেখেনি যে শুকনো বাঁশপাতা কেমন দাউ দাউ করে জ্বলতে পারে। নদীনালা খাল-বিল জলাভূমির দেশ হলেও এর চরিত্রে পাথুরে কাঠিন্য আছে। মানুষগুলো কেবল স্যাঁতসেঁতে জলাশয় নয়। সেখানে আগুনের সঙ্গে একটা সহজাত সম্পর্ক আছে।
আজকাল কেবলই ইচ্ছে করে রমিজার মাছ-কাটা বঁটিটা দিয়ে সব কচুকাটা করে ফেলতে। তখন অনেক রক্তের কথা মনে হয়। রমিজার মাছ-কাটা বঁটির গা বেয়ে তাজা ফটফটে মাছের রক্তের স্রোত নামে। কলীমের রক্তের রেখা মাটির বুকে শুষে যায়। মার-খাওয়া রমজান আলীর পিঠে রক্তের দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে থাকে। জবাই করা কবুতরটা বুড়ির উঠোনে লাফায়। ওর পায়ের আঙুল উপড়ে গিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। বুড়ির মনে হয় কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়।
হলদী গাঁ-র শরৎ এবার অন্য রকম। ওর মনের রঙের মত বদলে গেছে ঋতু। ভরদুপুর ঝিমায় না। পড়ন্ত বিকেল ক্লান্ত না। রাতের আঁধার বারুদের গন্ধের মৌতাতে মাতাল। হলদী গাঁ-র নিশুতি রাত কবে ফুরিয়ে গেছে। ঝি ঝি ডাকা, জোনাক-জ্বলা রাতগুলো এখন ফুটফাট ফাটে। তপ্ত কড়াইয়ে খই ফোটার মত ফেটে ছিটকে ওঠে। রাতের হদিস খুঁজতে খুঁজতে বুড়ির চোখ এখন উৎসবহীন জেগে থাকে না। মনে হয় রাতগুলো এখন পাখা মেলে উড়ে যায়। শুধু আঁধারে নিঃশেষ হয় না। ওর জন্যে এক টুকরো সলতের আলো জ্বেলে রাখে। সে আলোর রেখা ধরে ও হলদী গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে যায়। অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে যেতে পরে। যন্ত্রণা পাশে রেখে বুকের পদ্মদীঘি ভেসে ওঠে।
বুড়ির খোপের মোরগগুলো যেন এখন অন্যস্বরে ভোরের কথা ঘোষণা করে। ও বিছানায় শুয়ে শোনে। রইসের গায়ে কাঁথা টেনে দেয়। ওর জন্যে বুকের ভেতর মমতা উথলে উঠে। এখন রইস বুড়ির অনেক কাছের। রক্তের মধ্যে রইসের উত্তাপ। প্রতি রোমকূপে রইসের নিঃশ্বাস। ওর মুখ থেকে ঝরে পড়া লালা বুড়ির চেতনার গ্রন্থি নিবিড় করে। অনেক দূরে ফেটে-পড়া পুলের শব্দ ওর হৃদয়ে জেগে থাকে। বুড়ি বোঝে না কেন ছেলেটা এমন করে টানছে! ওকে যত্ন করতে ভাল লাগে। গোসল শেষে চুল আঁচড়ে দিতে ভাল লাগে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাত খাওয়া দেখতে ভাল লাগে। হাঁ করে ঘুমিয়ে থাকা চেহারাটা বুড়ির চোখে অপরূপ। রইস যেন নতুন করে আবার বুড়ির কোলে ফিরে এসেছে। ওর শৈশবের দিনগুলোয় বিস্ময়, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, নতুন মাতৃত্বের স্বাদ যেমন বুড়িকে মাতিয়ে রাখতো এখনো ঠিক তেমন লাগে। রইসও বুড়িকে তেমন করে আঁকড়ে ধরেছে। ও প্রায়ই রইসকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়। ও, সঙ্গে থাকলে বুড়ির অনুভূতি পাল্টে যায়। মনে হয় আছে, আমারও কেউ আছে। এমনি একটা বোধ ওকে ঘিরে থাকে। ও অসহায় হয় না কিংবা দারুণ একাকিত্ব বিমর্ষ করে রাখে না। খাকি পোশাক পরা লোকগুলোর সৈনিক চেহারা মুছে যায়। বুড়ির হলদী গাঁ তার নিজস্ব চেহারায় ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন এখানে কোন ভিনদেশীর আক্রমণ নেই, মৃত্যু নেই, রক্ত নেই, কান্না নেই। বুড়ির বুক চেপে আসে। আসলে তা নয়, শরতের হলদী গাঁ আশ্বিনের শিশির গায়ে মেখে দুপুর রাতের ছেলেগুলোর স্বপ্ন হয়ে যায়। বুড়িও সে স্বপ্নের অংশীদার।
কখনো কখনো বুড়ি রইসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে।
–ও রইস, রইস তোর খুব কষ্ট না রে? তোর বুকে অনেক কথা, মুখে নেই ! তুই কথা বলতে পারিস না। আমারও অনেক কষ্ট, আমি যুদ্ধ করতে পারি না।
বোবা রইস হাঁ করে মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–কি দেখছিস কি? কথা বলার জন্যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তো? হ্যাঁ, আমারও এমনি হয়। কাউকে কিছু বোঝাতে পারি না। তুই যেমন আমিও তেমন। আমিও তোর মত হাবা বোবা অকেজো। হলদী গার জন্যে কিছু করতে পারলাম না।
রইস গোঁ গোঁ শব্দ করে। মার হাত ধরে টানাটানি করে। পথে পথে দাঁড়াতে ওর ভাললাগে না। বাড়ি যাবার জন্যে তাগাদা দেয়। বুড়ি শিমুলতলা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পথ-ঘাট শুকনো খটখটে। বাতাসে হিম হিম ভাব। কার্তিকের শুরু হয়েছে। শিমের মাচায় বেগুনি ফুল ঝঝ করে। রইস একটা কঞ্চি দিয়ে ঘাস লতাপাতা খোচাতে খোচাতে পথ চলে। হঠাৎ করে বয়ে যাওয়া উত্তুরে বাতাসের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় বুড়ি। বাতাসটা গায়ে মেখে নিয়ে বলে, শীত আসছে রে রইস। শীতের রাতে ছেলেগুলোর বড় কষ্ট হবে। কেমন করে যে কি করবে ভেবে পাই না।
রইস বুড়িকে ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। ও বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছে। বুড়ি দাঁড়িয়ে শিমের বেগুনি ফুল দেখে। মাচার ওপর ফিঙে ঝোলে। ক্ষেতে লাল শাকও হয়েছে প্রচুর। ওর মন কেমন করে। কলীম লাল শাক খুব পছন্দ করত। রইস হওয়ার। আগে কলীম ওর সঙ্গী ছিল। বুড়ির হাত ধরে লাল শাক তুলতে যেত, বুড়ির সঙ্গে মারবেল খেলত। বড় হওয়ার পর বুড়ি খলুই জাল গুছিয়ে না দিলে মাছ ধরতে যেত না। বুড়ি তাড়াতাড়ি হেঁটে ঘরে চলে আসে। ভাত রাঁধতে হবে। রইসের ক্ষিধে পেয়েছে। আজ হাড়িতে পান্তাও নেই। বারান্দার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। পানি চিচিক্ করে চোখের কিনারে। জল থৈ-থৈ নদী এখন চোখ দুটো, নদীর তীরে কাশবন। কাশবনে সাদা বক। সাদা বকের ধবধবে পালক। বুড়ির মন এখন সাদা বকের ধবধবে পালক।