বুড়ি কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সরে আসে। কাদের আর হাফিজ চলে যাওয়ার দরুন রমজান আলী মার খেয়েছে। এজন্যে ওর মনে কোন কষ্ট নেই দেখে বুড়ি আশ্বস্ত হয়। এটুকুই চেয়েছিল। যত কষ্টই হোক সইতে হবে। ওদের যাওয়ার পথ খুলে রাখতে হবে। সেটা বন্ধ হতে দেয়া যাবে না।
গোয়াল থেকে গরু বের করে এনে বুড়ি বাঁশবনে এসে বসে। অনেকদিন পর আজ গরুটা ছেড়ে দেয়। একটু উঁচুকণ্ঠেই বলে, তুই আজ তোর খুশি মত চরে বেড়া। তোকে আজ বাঁধবো না। বুড়ি লটকন গাছের গুঁড়িতে হেলান দেয়। রমজান আলীকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানায়। মার খেয়েছে তবু বলেনি যে ওরা কোথায় গেছে। শুধু ওরা দুজন অক্ষম মা ছেলে হলদী গাঁ-র জন্যে কিছু করতে পারছে না। গোটা গাঁ জুড়ে তোলপাড় হয়ে বয়ে যায় ঘটনা। কত নিত্যনতুন খবর আসে। খবর আসে যুদ্ধের। ছেলেদের কৃতিত্বের! খবর আসে দানব হত্যার। কখনো কোন প্রিয় মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর। শব্দ আসে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের। প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যাওয়া ডিনামাইটের, বোমার। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছেলেদের হাতের রাইফেল হয়ে যেতে, ডিনামাইট হয়ে যেতে, বোমা হয়ে যেতে। ঐ রকম প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গিয়ে যদি একটা পুল উড়িয়ে দিতে পারতো? পারতো যদি মিলিটারি ক্যাম্প ধ্বংস করে দিতে? অসংখ্য মৃত সৈনিকের বুকের ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়ার মত বয়ে যেতে? মাঝে মাঝে মনে হয় যে একটা মেশিনগান হয়ে গেছে। ছেলেদের কাঁধে সওয়ার হয়ে কখনো ছুটে যাচ্ছে। কখনো পিঠের ওপর চড়ে বুকে-হাঁটা ছেলেদের সঙ্গী হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে। যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে পাট ক্ষেতে শুয়ে পঁচিশ বছরের দুর্দান্ত ছেলেটির স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে গেছে। বুড়ির ইচ্ছে করে সেই যৌবন ফিরে পেতে। সেই আশ্চর্য যৌবন যা নিয়ে আকাঙ্ক্ষার বস্তুকে নাগালে পাওয়ার জন্যে দুর্বিনীত হওয়া যায়। মাঝে মাঝে শিরশির করে উঠে বুড়ির অনুভূতি। কে যেন ওর গা ছুঁয়ে ভয়ানক শপথ করছে। কারা যেন বুড়ির বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর তখনই নাড়িতে গেঁথে থাকা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। গরুটা নিজের কাছে ফিরে পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়। ও দ্রুত চলতে গিয়ে বাঁশের মুথায় হোঁচট খায়। বুড়ো আঙ্গুলের নখ উল্টে যায়। রক্তাক্ত পা চেপে বুড়ি বসে পড়ে। হাতের কাছে শিয়ালমুথার পাতা ছিল। চিবিয়ে লাগিয়ে দেয়। ব্যাথায় টনটন করে। পা টেনে উঠে দাঁড়ায় বুড়ি। গরুটা কাছেই ছিল, বেশিদূর যায়নি। দড়িটা হাতের মুঠোয় ধরে ঘরে ফিরে আসে। কোনরকমে ওটাকে সজনে গাছের সঙ্গে বেঁধে বারান্দায় চাটাইয়ের ওপর শুয়ে পড়ে।
মাথা কেমন জানি করছে। ব্যথা বাড়তেই থাকে। হঠাৎ মনে হয় কষ্টটা ওর ভালই লাগছে। উপলব্ধি করলো কখনো নিজের শরীরের ব্যথা যন্ত্রণার বদলে আনন্দ হয়। নইলে তরুণ টগবগে ছেলেগুলো গুলী খেয়েও হাসিমুখে মরতে পারতো না। ওদের বুকের সুখভরা পদ্মদীঘি স্বাধীনতার থৈ-থৈ জলে উথাল হয়। বুড়ি রইসের দিকে তাকায়। ও আপন মনে হাসছে। রইস ওদের কারো মত নয়। ওর বুকে স্বাধীনতার পদ্মদিঘী নেই। পদ্মের গন্ধে মাতাল হয়ে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে দুর্দমনীয় রোষে ছুটে যায় না। ওর মুখের দিকে চেয়ে বুড়িকে এক অপরাধবোধে পেয়ে বসে। মনে হয় হলদী গাঁ ওদের চায় না। ওরা হলদী, গাঁ-র জন্যে কিছুই করতে পারছে না, ওরা মা ছেলে কেবল খায় আর ঘুমোয়। আর কোন কাজ নেই। হলদী গাঁ-র জন্যে ওদের যত ভালবাসাই থাকুক না কেন সব অর্থহীন। কলীম মরে গেছে, সলীম যুদ্ধ করছে। বুড়ির মনে হয় এটুকুই যথেষ্ট নয়। কিছু করা দরকার। আরো বড় কিছু। অনেক বড় ত্যাগ। ঐ যুদ্ধরত ছেলেগুলোর মত প্রাণের মায়া তুচ্ছ করা ত্যাগ। নিঃস্বার্থভাবে ছুটে গিয়ে বুক পেতে দেয়া। ঘুরে ফিরে আবার ভাবনা এসে আক্রমণ করে। হলদী গাঁ বুঝি ঘৃণা করছে। অকেজো, অকর্মণ্য বলে ঘৃণা। ঐ বাঁশবন, খালের ধার, শিমুলতলা, স্টেশনের। রাস্তা সবখান থেকে ঘৃণার ধুলো উড়ছে। সমস্ত শরীর ধুলোয় ধূসরিত। বিশ্রী নোংরা। চারদিকে। বুড়ির শরীর কেমন করে। নখের ব্যথা ভুলে গিয়ে উঠে বসে। রইস উঠোনে নেমে গেছে, বাঘার পাশে বসে ওর লেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
খবর আসে অনেক। যুদ্ধ জোর বাড়তে থাকে। রমজান আলীর ঘরে বসে কখনো চুপি চুপি স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনে ওরা। বুক ভরে ওঠে গর্বে, আনন্দে। রমজান আলী চরম পত্র শোনার জন্যে উন্মুখ থাকে। বুড়ি সব কথা বুঝতে পারে না। তবু শুনতে ভাল লাগে। কি যেন যাদু আছে ঐসব কথায়। ইদানীং দিনের বেলাও গুলি গোলার শব্দ ভেসে আসে। একে দুয়ে গায়ের অনেক ছেলে চলে গেছে। মনসুরের মত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের ভয়ে ওরা মুখে বুড়ো আঙ্গুল পুরে চুপ করে বসে থাকেনি। মনসুরের মত লোকদের বুকের জ্বালা বাড়িয়েছে। বুড়ির মনে হয় মনসুররা আর কয়জন? ওদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। কিন্তু সলীমরা অনেক। সলীম একটি ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। ও ভাল আছে। মাকে নির্ভাবনায় থাকতে বলেছে। মায়ের কাছে অনেক ভালবাসা জানিয়েছে। আরো বলেছে, একদিন ও স্বাধীন দেশের ছেলে হয়ে মার সামনে এসে দাঁড়াবে। বুড়ির চোখে পানি আসে। আনন্দ হয়। সলীম যুদ্ধ করছে। এমন ছেলেই তো চেয়েছিল। অহংকারে মাথা উঁচু করে বিজয়ীর বেশে যে এসে দাঁড়াবে ওর সামনে। শুধু কলীমের নিরুপায় মৃত্যু ভুলতে পারে না। ও কোন সুযোগ পায়নি। সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নিয়ে মরতো। তবু নাড়িতে গেঁথে থাকা কষ্ট এখন আর তেমন কাদায় না। সাহস ভেঙে দেয় না। বুড়ির মনে জোর ফিরে আসে।