–কেনো?
–আমি তোর চাইতে অনেক বড়।
–বয়সে কি? খেতে দাও তো ঠিক মতো।
–কি যে বলিস?
–খারাপ কি? কথায় আছে না পেটে থাকলে পিঠে সয়।
গফুর আর কথা বলতে পারে না। এ বুড়ির অভিমান না অভিযোেগ তাও বোঝা দুষ্কর। ওর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার এই এক দোষ। বিশেষ জায়গায় এসে হঠাৎ করে থেমে যেতে হয়। আর এগুনো যায় না। ওর সঙ্গে গল্প খুব একটা চলে না। কোথাও না কোথাও এসে বুড়ি এমন করে যতি টানে যে থেমে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সেটা কাজের কথাই হোক কিংবা এমনি অবান্তর কথাই হোক। হঠাৎ করে, চুপ করে যায়। বেশি কথা বলতে চাইলে হুঁ-হা ছাড়া জবাব দেয় না। তখন গফুর নিরুপায় হয়ে বলে–তামাক আন বুড়ি। বুকটা কেমন খালি খালি ঠেকছে। বুড়ি হাসতে হাসতে উঠে যায়।
তবে গফুরের বয়স নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না বুড়ির। এই নিয়ে ও একদম মাথা ঘামায়নি। উঠতি বয়সের তরুণ উচ্ছাসের স্বপ্ন ফুটে ওঠার আগেই গফুরের নিরাপদ আশ্রয়ে ছিটকে পড়ে নির্বিবাদ হয়ে গেছে ও। ভেবে আর লাভ কি? বরং এই ভালো। নিজের মনের সঙ্গে খুনসুটি জমে বেশি। ওর কাছে গফুরের দাবি খুব নেই। গফুর ওকে তেমন বিরক্ত করে না। তবুও মাঝে মাঝে যখন গফুরের উপস্থিতি অসহ্য লাগে তখন বুকের ভেতরের দমধরা স্তব্ধতা আকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একদম একলা থাকতে। কার্তিক মাসের হিম-পড়া রাতে বাইরে গিয়ে বসে থাকে। বিছানায় কাঁথার নিচে গফুরের বুকের উষ্ণ আমেজ পানসে লাগে। প্রতিদিনের একঘেয়েমীতে সুখ কৈ? বাইরে পাখি ডাকে। তেঁতুল গাছের মাথার ওপর হিম ঝরে। সজনের ডাল নড়ে। বুড়ি পা ছড়িয়ে বসে থাকে। ঠাণ্ডা ঝলক-বাতাস গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়। যেনো বুড়ির শৈশবের কেউ অনেকদিন পর পথ ভুলে ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে এসেছে। ওর বেশ লাগে। নেশার মতো যেনো। সাধ্যি-সাধনা করে টেনে নিয়ে আসে গফুর। গফুরের কণ্ঠে মিনতিই থাকে বেশি। বয়সের অনেকটা পার্থক্যের জন্যে বুড়ির উপর অসীম মমতা গফুরের। বাহুতে জোর থাকলেও গফুর তার অপব্যবহার করেনি কোনদিন। আর সেই নীরব বদান্যে ভালোবাসায় ধরা দেবার মতো যথেষ্ট চতুরতা ছিল বুড়ির আচরণে। কখনো কখনো ভোর রাতের দিকে মাছ ধরতে বেরুতো ওরা। দিনের কড়া আলোয় দেখা পরিচিত গা-টা রহস্যময় মনে হয় বুড়ির কাছে। ঠিক তেমনি অনেক দিনের জানাশোনা ভাই যেমন স্বামী হয়। ভাইকে স্বামী হিসেবে আবিষ্কার করার মতো মনে হয় গাছ-গাছালি, ঘর-বাড়ি আর জলে ডুবে থাকা প্রান্তর। বুড়ির জমাট ধরে থাকা মনের কাঠিন্যে এক পেলব ছোঁয়া দিয়ে যায়। গফুরকে মনে হয় অনেক দূরের। অনেক কালের অদেখা। কাছের মানুষ পর-পর লাগে। বাইরে এলেই বুড়ির অনুভূতি পাল্টে যায়। ও তখন উজ্জ্বল হয়–ওর চোখে-মুখে আনন্দের জ্যোতি ফুটে বেরোয়। ঘরে ও একদম নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। বাইরে এলে সে খোলসটা দুম করে ফেটে যায়। বুড়ির কিশোরী চেহারায় প্রকৃতির মাধুর্য প্রতিফলিত হয়। বুড়ি আর বুড়ি থাকে না। ও তখন গফুরের কাছাকাছি আসে।
গফুর হেঁচকা টানে ওকে ডিঙিতে তুলে নেয়। তারপর জোরে একটা ঠেলা দিয়ে নিজে উঠে বসে। জলের বুকে এপাশ-ওপাশ করে ছোট্ট ডিঙি। গফুর ওকে ভয় দেখানোর জন্যে ডিঙির দুলুনি বাড়িয়ে দেয়। এতে ভয় যতো লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে মজা। ওতো উদ্দাম বেপরোয়া হতেই চায়। নৌকা ডুবে গেলেই বা কি? ভাসতে ভাসতে ও চলে যেতে পারবে অন্য কোথাও। এখানে ফিরে আসার দায়ভার থাকবে না। গফুর বলে–ভয় লাগে বুড়ি?
–ভয় কিসের তুমি তো আছো?
বুড়ি সজোরে গফুরের হাঁটু জড়িয়ে ধরে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নৌকোর ওপর।
–বাইরে এলে তুই বদলে যাস বুড়ি? ঘরে তুই যেনো কেমন মনমরা থাকিস? মনে হয় আমি তোর পর। ভালো করে কথাই বলিস না?
–বাইরটা আমার ঘর যে। বাইরে এলে আমার প্রাণ ভোমরা ছাড়া পায়।
–এজন্যেই তোকে সঙ্গে নিয়ে আসি।
গফুর আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে। এ যাত্রায় বুড়ির সঙ্গে ওকে কথায় ঠকতে হয়নি। ও একটা যুৎসই উত্তর দিতে পেরেছে। গর্বে আনন্দে গফুরের বুক ভরে যায়।
শান্ত পানিতে নৌকা ভাসে। গফুর বৈঠা ছেড়ে দিয়ে বুড়িকে কাছে টেনে নেয়। বুড়ির কিশোরী ঠোঁটে অপূর্ব মাধুর্য। গফুর পাগলের মতো নেশা খোঁজে। দিক ভুল হয়ে যায় গফুরের। কোনো দিশা করতে পারে না। বুড়ি এখন অনেক কাছের–অনেক উষ্ণ অনেক মিনতি ভরা। আঃ বুড়ি কেনো সব সময় এমন থাকে না। নৌকা যখন অন্যদিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয় গফুর তখন আবার বৈঠা নেয়। ও শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকে। তখন ও নিজের মধ্যে থিতিয়ে যায়। বুড়ির ভাই বলে, গফুর বুড়িকে মাথায় তুলেছে। একেই নাচুনে মেয়ে তার উপর পড়েছে ঢোলের বাড়ি। বুড়ি ভাইর কথার জবাব দেয় না। জবাব দিয়ে ঝামেলা বাড়াতে চায় না। মা এ ব্যাপারে বুড়িকে প্রশ্রয় দেয়।
ওরা ওদের মতো থাকুক না। বিয়ের পর বুড়ি যে সব মেনে নিয়েছে এই আমার কপাল। মেয়েটা শান্তিতে থাকলেই আমি বাঁচি।
মা অনেক বুড়িয়ে গেছে। চোখে ঝাপসা দেখে। তবু বুড়ির জন্য উৎকণ্ঠার শেষ নেই। শৈশব থেকেই এ মেয়েটির আচরণ মাকে বড় বেশি ভাবিয়েছে এবং এখনো ভাবায়। পাড়াপড়শি মাঝে মাঝে বুড়িকে মন্দ বলে, মেয়ে মানুষের একি স্বভাব? এইসব। ভাল না বুড়ি।
বুড়ি ঝগড়া করে না। মুখের উপর জবাব দেয় না। সেই জন্য কেউ ওর সঙ্গে তেমন সুবিধে করতে পারে না। বুড়ি চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসে। যারা নিজেদের ভালমন্দ বোঝে না তারা ওকে ভালোমন্দের কি বোঝাবে? ও আপন মনে হাসে। এসব কথা শুনতে ওর ভালোই লাগে। কেননা এসব কথায় ওর কিছু যায় আসে না।