–জামাই যখন নেই মেয়েটাকে আমি নিয়ে যাই কি বলেন আপনি?
–খুব ভাল হবে। আমিও ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
–হ্যাঁ, এত বড় বাড়িতে আপনারা দুজন মেয়ে মানুষ মাত্র। এতদিন যে কেমন করে ছিলেন ভাবতেও অবাক লাগে। আল্লার অশেষ দয়া বলে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। যাক যা হবার হয়েছে। এখন ভালোয় ভালোয় মেয়েটাকে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।
রমিজার বাবার কথায় বুড়ির মন খারাপ হয়ে যায়। কোন উত্তর দিতে পারে না। সব কথাই সত্যি। ইচ্ছে করলে রমিজা নিজেও লোক জোগাড় করে চলে যেতে পারত। যায়নি। বুড়ির কি ক্ষমতা আছে রমিজাকে রক্ষা করার? তাই অভিযোগের জবাব নেই। আপত্তি করে রমিজা নিজে।
–আমি চলে গেলে আম্মা একলা কি করে থাকবে বাবা?
–বুড়ি তাড়াতাড়ি বলে, আমার কথা তোর ভাবতে হবে না। আমি ঠিক থাকতে পারব দেখিস। আমি বুড়ো মানুষ কোন মতে দিন ঠিকই চলে যাবে! তোকে নিয়ে আমার যত ভয়।
–কিন্তু তোর এখানে থাকা ঠিক হবে না রমিজা। কলীম থাকলে তবু একটা কথা ছিল। কেউ নেই যখন বেশি সাহস করা ভাল না।
–আশপাশের ঘরে তো লোক আছে বাবা?
–পাড়াপড়শি দিয়ে কি হয়? আপনজন থাকতে হয়।
–কিন্তু বাবা কপালে যা আছে তাই হবে সে যেখানেই থাকি না কেন? তুমি চেষ্টা করলেই কি কপালের লিখন ঠেকাতে পারবে?
–তাই বলে জেনেশুনে তো তোকে আর মরতে দিতে পারি না? রমিজার বাবার কণ্ঠে রাগ এবং বিরক্তিও। মেয়ের বাচালতায় রুষ্ট।
–সব সময় বড়দের সঙ্গে কথা বলা তোর একটা অভ্যোস হয়ে গেছে রমিজা। আদব কায়দা শিখতে চেষ্টা কর। তোর চেয়ে আমি কম বুঝি না। আমাকে বেশি বোঝাতে হবে না। কি ভাল কি মন্দ সেটা আমি ভালই জানি।
রমিজার বাবা রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার মেজাজটা সব সময় একটু চড়া।
–আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না বেয়াই সাহেব। ও ঠিকই যাবে। আপনি এখন আরাম করুন। আমিও চাই না যে ও এখানে থাকুক।
বুড়ি জোরের সঙ্গে কথা বলে। রমিজার কোন যুক্তিই আর খাটে না। ও বাপের জন্যে ভাত আনতে রান্নাঘরে যায়। বুড়ি ঘুমন্ত নাতির পাশে গিয়ে বসে।
রাতে দুজনের কারোই ঘুম আসে না। কিছু দেখা যায় না তবু আঁধারেই চেয়ে থাকে। বুড়িকে ছেড়ে যাবে না বলে জেদ করতে থাকে রমিজা। কান্নাকাটিও করে। বুড়ি কিছু বলতে পারে না। মনটা এখন উদোম মাঠের মত। রমিজাকে ছাড়া এই শূন্য বাড়িটা ওর কাছে কবরের চেয়েও বেশি। কিন্তু উপায় নেই। কলীমের মৃত্যুর মত এ কষ্টও চেপে রাখতে হবে। শুধু নিজের দিকটা ভাবলে তো চলবে না। বাপের মন মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভাল।
–আমি গেলে আপনার বুকটা ফেটে যাবে আম্মা? তাছাড়া ঐ দুষ্টুটাকে ছেড়ে আপনিইবা থাকবেন কি করে? আমার মন চায় না যেতে।
–আচ্ছা এখন ঘুমো। সকালে দেখব।
–বাবাকে আপনি জোর দিয়ে বললেই হবে। বাবা যে কি একটুও কিছু বুঝতে চায়। স্বার্থপরের মত আমি চলে গেলেই হল আর কি? বাবা সব সময়ই এমন। নিজে যেটা বুঝবে সেটা করবেই করবে। আর কারও কথা শুনতেই চায় না। জানেন আম্মা ছোটবেলায় দেখেছি এই নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রায়ই লোকজনের ঝগড়া হত।
–আচ্ছা এখন ঘুমতো। ছেলেটা আবার উঠে যাবে।
রমিজা চুপ করে যায়। বুড়ি পাশ ফিরে শোয়। ঘুম কি আর আসে? সলীম যেদিন যায় সেদিনও এমনি করে জেগেছিল রাত্রে। কলীম মারা যাবার পর সাত দিনতো চোখের পাতা এক হয়নি। এখন রমিজাও যাবে। ওকে যেতেই হবে। ও যত কথাই বলুক ওর বাবা ওকে ছাড়বে না। জোর করে হলেও নিয়ে যাবে। বুড়ির জন্য ওদের কিসের টান? বুড়ি মরলেইবা ওদের কি আসে যায়? বুড়ির চোখের কোণে জল আসে। ভয়ানক নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। হাত বাড়িয়ে রইসকে কাছে টানে। ও এখনও আছে। ওর কোথাও যাবার জায়গা নেই। কোথাও যাবার ক্ষমতাও নেই। রইস বুড়ির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারে না। তবুও বুড়ি রইসকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
রাত কত হবে কে জানে। পুবদিকের ঘর থেকে মেয়ে-কণ্ঠের চিৎকার আসে। কান-খাড়া করে থাকে দুজনে। শোনে দুড়দাড় শব্দ। মেয়েটির চিত্ত্বার থেমে গেছে। কেউ যেন ওর মুখে হাত চাপা দিয়েছে। ও গোঙাচ্ছে। বেশিক্ষণ সে শব্দ উঠোনে থাকে না। দ্রুত মিলিয়ে যায়। গোঙানির শব্দ এসে রমিজার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটায়। ভয়ে ভয়ে বুড়িকে ডাকে।
–আম্মা শুনছেন?
–হ্যাঁ।
–ফুলি না?
–সে রকমই তো মনে হয়। ফুলিই হবে।
–কি হবে আম্মা?
–কি আর হবে। চুপ করে শুয়ে থাক। আল্লাকে ডাক। এক সময় শব্দ মিলিয়ে যায়। ওরা চলে যাবার অনেক পরও ভয়ে কেউ সাড়া দেয়। ঝিঝিটের ডাক জোরদার হয়ে ওঠে। বুড়ি বিছানায় উঠে বসে। পাশের ঘরে রমিজার বাপ কাশে। তাও খুব আস্তে। গলা চেপে চেপে। বুড়ির ইচ্ছে করে দরজা খুলে বের হতে।
–আম্মা উঠলেন কেন?
–বাইরে যাব।
–না। রমিজা চাপা আর্তনাদ করে ওঠে। কে জানে দুএকজন আবার ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে কি না?
বুড়ি থিতিয়ে যায়। তাই তো? যদি এ ঘরে আসে?
–আম্মা ঘুমান। বাবা বোধহয় জেগে আছে।
রমিজা ফিসফিস করে বলে।
বুড়ি বসেই থাকে। অক্ষমতার যন্ত্রণায় ফুলে ওঠে শরীর। এতবড় একটা ঘটনা ঘটল অথচ কেউ প্রতিবাদ করেনি। লাঠি নিয়ে বের হয়নি। দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণও না। নির্বিবাদে কাজ সেরে চলে যায় ওরা। টেনেহিচড়ে নিয়ে যায় ফুলিকে। ও কারও কাছে কোন সাহায্য পেল না। ওর জন্যে কেউ ছুটে এলো না। আচ্ছা এমন কোন যুবক কি ছিল না যে ফুলিকে ভালবাসে? ফুলিকে যে ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে পারতো? ফুলির জন্যে মরে যেতেও পিছপা হতো না? বুড়ির মাথা ভার হয়ে ওঠে। নিথর রাত নীরব, নিশ্রুপ। ওর চোখের কোণে জল চিকচিক্ করে। ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে মুখ ঘঁষে। মনে মনে বলে, আল্লা আমাদের জন্যে মানুষ দাও। শক্তিশালী, সাহসী মানুষ দাও। মানুষ দাও। মানুষ দাও। ভয়হীন, যোদ্ধা, লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ দাও। হলদী গাঁয়ের মাটি খুঁড়ে চারদিক তোলপাড় করে ছুটে আসুক হাজার হাজার মানুষ। বুড়ির যে। কি হয়। বুড়ি বারবার একটা কথা মনে মনে আওড়াতে থাকে। যতভাবে, যত মিনতিতে চাওয়া যায় আল্লার কাছে সেইভাবে প্রার্থনা করে। এমন তন্ময় হয়ে আকুল হৃদয়ে বুড়ি কোন দিন আর কোন প্রার্থনায় নিমগ্ন হয়নি। বাকী রাতটুকু ওর আর ঘুম আসে না। ভোর হয়ে আসছে। অনেক রাত জেগে রমিজা এখন ঘুমোচ্ছে। বুড়ি দরজা খুলে বাইরে আসে। বুক ভরে শ্বাস নেয়। মনে হয় আজই চলে যাবে রমিজা। সন্ধ্যারাতে ওর কান্নাকাটিতে যে দুর্বলতাটুকু মনে জমা হয়েছিল মধ্যরাতে ফুলির চিৎকার সে দুর্বলতার রেশটুকু কাটিয়ে দিয়ে যায়। ঘাটে মুখ ধুতে গিয়ে বুড়ির চোখের বিরামহীন নোনা জল পুকুরের পানির সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়।