ছেলেকে নিয়ে রমিজার বড় ভয়। ও সারাক্ষণ ছেলেটাকে বুকে আঁকড়ে বেড়ায়। সলীম চলে যাবার পর থেকে একদম দুর্বল হয়ে গেছে। কারো সঙ্গে জোর করে কথাও বলতে পারে না। যেন সলীম চলে যাবার দায়-দায়িত্ব সব ওর। কলীমের মৃত্যু ওকে আরো অপরাধী করেছে।
–ও না গেলে ছোট ভাই বোধ হয় মরতো না, না আম্মা?
–কি জানি মা সবই আল্লার ইচ্ছা।
বুড়ি উদাসীন হয়ে থাকে। বলতে পারে না যে সলীম না গেলে ওরা সলীমকেই, মারতো। অথবা দুজনকেই মেরে ফেলতো। তখন কি হত রমিজার? কলীম গেছে, কলীমের কোন পিছু টান নেই। কিন্তু সলীম গেলে রমিজার বৈধব্য বুড়ির বাকি জীবনটুকুতে কাঁটা হয়ে থাকত। তার চেয়ে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সলীম যেন ঠিকঠাক ফিরে আসে এই দোয়াই করে। এর মধ্যেই বুড়ি কলীমের মৃত্যুর সান্ত্বনা খোঁজে। কিন্তু রমিজা কোন সান্ত্বনা পায় না। ওর বিবেক ওকে কাঁদায়। রমিজা প্রায়ই কাঁদে। পুকুর ঘাটে বসে, বিছানায় শুয়ে, ভাত রাঁধতে বসে সব সময়ই কাঁদে। বুড়ির মনে হয় শুধু কলীম নয়, সলীমের জন্যেও কাঁদে ও। সেই যে গেল ছেলেটা কতদিন হয়ে গেল অথচ কোনো খবর নেই। বেঁচে আছে, ভাল আছে এই একটা খবরও কি সলীম পাঠাতে পারতো না? কোন দুর্গম এলাকায় আছে যে খবর আসে না? বুড়ির রাগ হয়। সলীম নেই, কলীম নেই। রইস বেঁচে থেকেও না থাকার মত। শুধু ঐ একরত্তি ছেলেটা এখন এই বাড়ির প্রাণ। তাও জোরে কাদার অনুমতি নেই ওর। রমিজার কড়া শাসন ওকে দমিয়ে রাখে। হাত পা ছুড়ে ও যখন হাসে আর খেলে তখন বুড়ির বুক
জুড়িয়ে যায়। ভয়-কাতুরে রমিজা শুকনো মুখে হাসতে চেষ্টা করে।
-বুড়ি বলে, দ্যাখ রমিজা দ্যাখ। ওর দিকে তাকিয়ে সাহসী হতে শেখ।
–ওর মত বয়স পেলে আমিও হাসতাম আম্মা।
–সাহস বুকের মধ্যে থাকে রে। ওর জন্যে বয়স লাগে না।
রমিজা কথা বলে না আর। ও জানে ওর কোন সাহস নেই। ছোটবেলা থেকেই ও একটা ভীতুর ডিম। তাই সারাদিন বাড়িতে ও চুপচাপই থাকে। প্রায় নিঃশব্দে। একদম থাকার মত।
গ্রামের অবস্থা দিনদিনই খারাপ হতে থাকে। ওরা একটা নারকীয় উৎসবে মেতে উঠেছে। সামান্য ছুতো ধরে গুলি করে। ঘরে আগুন দেয়। লাশ টেনে আধাআধি মাটি চাপা দেয়। শকুন ভীড় জমায়। শেয়াল টেনে বের করে সে সব লাশ। গ্রামের লোক ভয়ে সেদিকে যেতে সাহস পায় না। কদিন পর মাথার খুলি গড়ায় মাঠে। হাড়ি জেগে থাকে মাটির ফঁাকে। কখনো মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে ঘুম ভেঙে যায় ওদের। বিছানায় উঠে বসে থাকে। বাকি রাতটুকু কেউ ঘুমুতে পারে না। কখনো কখনো রাতের অন্ধকারে ওদের দুতিনজন মেয়ে খুঁজতে আসে। ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে চলে যায়। সেসব মেয়েরা আর ফিরে আসে না। কাউকে ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। কাউকে প্রয়োজন শেষে মেরে ফেলেছে। দিনের বেলায় গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি নিয়ে যায়। জবাই দিয়ে ক্যাম্পে উৎসব করে। হৈ হুল্লোড় চিৎকার ভেসে যায় অনেক দূর পর্যন্ত। বুড়ির দুটো গরু নিয়ে গেছে। খুঁজতে গিয়ে দেখেছে জবাইয়ের দৃশ্য। আর একটা গাছতলায় বাঁধা ছিল। ভীষণ ভাবে ডাকছিল সে গরুটা! বুড়ি কাছে যেতে পারেনি। সে সাহস হয়নি। শুধু হাম্বা ডাকে থরথর করে কাঁপছিল হাঁটু দুটো। ফিরে এসে হাউমাউ করে কেঁদেছিল বুড়ি। রমিজা সান্ত্বনা দিয়েছিল, আম্মা থাক দরকার নেই আমাদের গরুর। এর চেয়ে বড় বিপদও তো আমাদের হতে পারতো। হ্যাঁ, তা হতে পারতো। ওরা ঘর পুড়িয়ে দিতে পারতো। বুড়িকে মেরে ফেলতে পারতো। রমিজাকে ধরে নিয়ে যেতে পারতো। বেয়োনেটের মাথায় গেঁথে নিতে পারতো বুড়ির প্রিয় নাতির শরীর।
–ভেবে দেখেন আম্মা ছোটভাইকে মারার পর ওরা আর এ বাড়িতে আসেনি। বুড়ির কান্না থেমে যায়। মাঠ থেকে গরু নিয়ে গেছে যাক গে।
–বড় মায়ার গরু ছিল রে রমিজা!
–কি আর করবেন।
রমিজা হাত পাখা দিয়ে বুড়িকে বাতাস করে। রমিজার সান্ত্বনার কথায় বুড়ি চুপ করে যায় কিন্তু বুকের নিচটা ঝাঁঝরা হয়ে থাকে। ভুলতে পারে না সেই হাম্বা ডাক।
রমিজাকে নিয়েও আতংক দানা বাঁধতে থাকে বুড়ির মনে। ভয়ে কিছু বলতে পারে না ওকে। রমিজাও বোঝে। কিন্তু কিছু বলে না। ওর যৌবন এখন ভয়ের কারণ। যে কোন মুহূর্তে তছনছ করার জন্য দর দল আসতে পারে। রমিজার চুপসে যাওয়া শুকনো গাল নিষ্প্রভ হতে থাকে দিন দিন। কাজ কর্মে মন নেই। উৎসাহও নেই। উঠোনে শ্যাওলা জমে। আগাছা গজায়। এখন আর লেপে-পুছে ততকে ঝকঝকে করে রাখে না ঘর-দুয়োর। চুলোয় তিন বেলার আগুন এক বেলায় জ্বলে। ও এখন আর দাউদাউ করে আগুন জ্বালে না। টগবগিয়ে ভাত ফোটে না। বুড়িও বসে বসে সে আগুন দেখে না। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বুড়ি বাকী একটা গরু নিজেই চরাতে নিয়ে যায়। বাঁশবন পর্যন্ত কিংবা খালের ধারে, এর বেশি যায় না। শেষ সম্বল এই গরুটা কিছুতেই আর মাঠে চরতে পাঠায় না। কখনো বুড়ি নিজেই ঘাস কেটে আনে। খড় যোগাড় করে। হাঁসগুলোকে সন্ধ্যার আগে খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দেয়। নিজেরাও খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলে। রাত্রিবেলা আর বাতি জ্বলে না ঘরে। বুড়ি অনুভব করে অভাব ক্রমাগত মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসছে। শুধু ভয়ে নয় কেরোসিনের অভাবেও বাতি জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। সারা বছরের চাল ঘরে আছে বলে ভাত জুটছে। এর বাইরেও নিত্যদিনের টুকিটাকি কত কি লাগে সেগুলো আর জোটে না। গতকাল রমজান আলীকে দিয়ে একমণ ধান বিক্রি করিয়েছে। তার থেকে হলুদ, মরিচ, লবণ, তেল, সাবান কিনেছে। কোনদিন শাকভাজি, কোনদিন কাঁচা মরিচ এই তো চলছে। বুড়ি কি করবে কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না।
০৯. রমিজার বাবা রমিজাকে নিতে আসে
এর মাঝে রমিজার বাবা রমিজাকে নিতে আসে। সলীম চলে যাবার খবরটা ওরা খুব দেরিতেই পেয়েছে। তাই এতদিন আসেনি। রমিজার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে। বলে খুশি হয় বুড়ি। ওর যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তাহলে তাদের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। কি জবাব দেবে ওদের প্রশ্নের। তার চাইতে রমিজার যাওয়া ভাল। কিন্তু পরক্ষণে বুকটা আবার দমে যায়। এ শূন্য ঘরে কি করে দিন কাটবে ওর? দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রমিজার বাবার সঙ্গে কথা বলে।