কোনরাতে গফুর টের পেলে জিজ্ঞেস করে–কোথায় গিয়েছিলে বুড়ি!
–বাইরে।
–কেনো?
–এমনি। ঘুম আসছিল না।
গফুর কথা বাড়ায় না। আবার ঘুমিয়ে যায়। আর বুড়ি বাকি রাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়। কখনো কখনো যখন গফুরের ভীষণ ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে না তখন ওর পুলক লাগে। গফুরের নরম মিনতি রেলের ঝিকিমিকি শব্দের মতো মনে হয়। গফুরের বুক আঁকড়ে ধরে একটা আদুরে বিড়ালের মতো মুখ ঘষে। আর গফুরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা যখন দীপ্র হয়ে ওঠে তখন অবলীলায় শান্ত হয়ে যায় ও। গফুরের বুড়ি ডাকের সঘন মাদকতায় সাড়া দেবার মতো অবস্থাও নিঃশেষ হয়ে যায়। হারিয়ে যেতে থাকে সেই না দেখা জগতটায়। অনবরত ডুবে যায় ট্রেনের ঝিকিমিকি শব্দের অতল তলে। কেউ আর ওকে ধরতে পারছে না। আর এভাবে সকলের নাগালের বাইরে ছুটে যাওয়ার যে কী সুখ! যে না বোঝে তাকে কীভাবে বোঝাবে বুড়ি।
মাঝে মাঝে গফুর একটু অবাক হয়ে ওর কিশোরী বউকে দেখে। এই মেয়েটি ওর বউ হবে কোনদিন চিন্তা করেনি। কবে যে ও বড় হলো, খেলতে খেলতে কেমন করে ওর ঘরে এসে উঠলো ভাবলে লজ্জা পায় গফুর। বুড়ির মুখের দিকে তাকাতে পারে না। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। বুড়ি তখন হেসে গড়িয়ে পড়ে।
–কি দেখ অমন করে?
–তুই সুখী হয়েছিস বুড়ি?
–সুখ কি?
বুড়ি পাল্টা প্রশ্ন করে। এ প্রশ্নের উত্তর গফুর দিতে পারেনা। উত্তর জানেও না। বুড়ির কৌতূহল, জিজ্ঞাসা ইত্যাদির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য গফুরের নেই। হলদী গাঁয়ের ছোট পরিসরে থেকেও বুড়ি যে কোথা থেকে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করে তা গফুর বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারে না। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে তাড়াতাড়ি বলে, তামাক আন। বুড়ি। বুকটা কেমন খালি খালি ঠেকছে।
ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খেতে না পারলে গফুরের বুক অমন করে। বুড়ি তা জানে। কিন্তু সুখ কি বুড়ি নিজেও তা জানে না। ভাত রাধা, খাওয়া, রাত্রিবেলা স্বামীর সঙ্গে ঘুমোনো–এর নাম কি সুখ? হ্যাঁ এ যদি সুখ হয় তাহলে বেশ আরামেই আছে ও। জীবনের গতানুগতিকতায় একটা স্রোত এসে মিলেছে মাত্র। হয়তো তাও নয়। চলার পথে নুড়ি কুড়িয়ে পাওয়ার মতো। না ঠিক হলো না। ধানের ছড়া কুড়োতে কুড়োতে হাঁসের ডিম পেয়ে গেলে যেমন চিৎকার করে ওঠে তেমনি। ওর জীবনে গফুর ঐ চিল্কারের মতো একটা ধ্বনি। অব্যক্ত বিস্ময়ে, গভীর আনন্দে বুকের অন্তঃস্থল থেকে। বেরিয়ে আসা শব্দ নয়। তেমন করে ওকে ওলোটপালোট করে দেয়নি। আসলে বুড়ি কোনো ঘটনাকেই প্রাধান্য দিতে চায় না। তার গুরুত্বকে আলাদা করে দেখতে বসে না। মনের সঙ্গে খুব গভীরভাবে না মিললে বুড়ি অনায়াসে তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে। অথচ অন্য কোনো মেয়ে হলে জীবনের এ পরিবর্তনকে বাঁক বদলের লগ্ন বলে ধরে নিত।
হলদী গাঁয়ের গ্রামীণ আবহাওয়ায় এমন কোনো কঠিন ধাতু ছিলো না যা বুড়িকে নিরেট করতে পারত। অথচ আশ্চর্য তার মনের জোর। বুড়ি গাঁয়ের সেই সঁাতসেঁতে পরিবেশের মতো এক ভিজে মন লালন করেনি। সে মনের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উষ্ণতা বিরাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। যেদিন বুড়ি কাদতো সেদিন বাড়ির সবাই ভাবতো আজ সাংঘাতিক রকমের কিছু হয়েছে। অল্পে কেঁদে ভাসিয়ে দেবার মতো মেয়ে ও নয়। অথচ কেউ বোঝে না বাহ্যিক কোনো কারণে বুড়ি কাঁদে না। ওর অন্ত রের অন্তর্গত বিষাদ ওকে কাদায়। সে বিষাদ সামগ্রিক জীবনের পারিপার্শ্বিককে কেন্দ্র করে অহরহ আবর্তিত হয়। কোনো সাংঘাতিক ঘটনা হয়তো কখনো ওকে আলোড়িত করে না। অথচ কোনো তুচ্ছ ঘটনা বিষাদের বরফ হয়ে ওকে জমাট করে তোলে। ছেলেবেলায় বুড়ি যখন রামধনু-রঙ পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মার। ডাকে সাড়া দিতে ভুলে যেতো তখন মা অনুযোগ করতো–এ মেয়েকে নিয়ে কি যে করবো আমি? তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে বলে রাখলাম বুড়ি? এই বুড়ি শোন, ফিরে আয়? হতচ্ছাড়া মেয়ে! বুড়ি মার কথায় কানই দিতো না। মাকে ভেংচি কেটে দৌড়ে বেরিয়ে যেতো। মা পিছু ডাকতে ডাকতে দরজা পর্যন্ত আসতেন কিন্তু বুড়ি ততোক্ষণে হাওয়া। মার কথা শোনার মতো সময় ওর নেই। মার কিইবা কথা থাকতে পারে? কেবল ওকে আটকে রাখার চেষ্টা। ও তা বোঝে। আর বোঝে বলে বেড়ি ভাঙতে দুর্বার হয়ে ওঠে। মা কোনদিন ওকে শাসনের বশে আনতে পারেননি। তাই ওর বিয়ে নিয়ে ভীষণ শংকিত ছিলেন। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে বুড়ির নির্বিকারত্ব দেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
ছেলেকে বলেছিলেন–ও যে এতো শান্ত থাকবে আমি বুঝতেই পারিনি রে?
ছেলে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসেছিল, আমি জানতাম। বিয়ের আগে যতো যাই করুক, বিয়ের পর মেয়েরা একদম সোজা হয়ে যায়। কতো মেয়ে দেখলাম।
আড়াল থেকে ভাই আর মায়ের কথা শুনে বুড়ি মনে মনে হেসেছিল। আসলে বুড়ির যতো জ্বালা মনকে নিয়ে। সেই মন কেউ দেখতে পায় না বলেই বুড়ি কখনো ভালো, কখনো মন্দ। কখনো বিপজ্জনক, কখনো গোবেচারা। তাছাড়া ও নিজের বলয়ে থাকতেই ভালোবাসে। অকারণে যেচে কারো কাছে নিজের কথা বলা ওর একদম
পছন্দ নয়। বুড়ির এই নিজস্ব ক্ষেত্র আছে বলেই তার চাষবাস আছে, ফসল ফলানো। আছে, তার মাড়াই আছে, গোলায় ভরা আছে। অন্য কাউকে ওর প্রয়োজনই হয় না। মা আর ভাই এর বেশি কিইবা ভাবতে পারবে?
নিরীহ গোবেচারা স্বামী বুড়ির। কোন দিন বুড়ির মতের বিরুদ্ধে কথা বলে না। পারতপক্ষে বকে না। ঝগড়া বাধাতেও অপারগ গফুর। বরং সারাক্ষণ বুড়িকে তুষ্ট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় গফুরের সব কাজে। ও যেন কোন অসাধারণ বস্তুর পবিত্রতা রক্ষার্থে সর্বদা ব্যস্ত। তাই পারিবারিক কলহ কখনো দানা বেঁধে ওঠে না। বুড়ি যা বলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নেয় গফুর। বুড়ির অন্যায় আবদার নেই, হিংসা নেই, খুঁটিনাটি বস্তু নিয়ে কারো সঙ্গে বাধে না। বুড়ির কাছে গফুরের কৃতজ্ঞতা এজন্যেই। মাঝে মাঝে ওকে আদর করতে গিয়ে কেমন থমকে যায় গফুর। ওর মুখটা খুব কাছে টেনে নিয়ে বলে–তোকে বিয়ে করা আমার বোধ হয় ঠিক হয়নি বুড়ি।