বুড়ি তখন হয়তো বাগানের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে বড় বাদাম গাছের তলায় হাত পা ছড়িয়ে বসে জিভে শব্দ তুলে তেঁতুল চাটছে। দুপুরের খাবার কথা ওর মনে নেই। একা থাকতে কি যে ভালোলাগে! বেশি লোকজনের মাঝে ওর কেমন হাঁফ ধরে যায়। এই গাছ-গাছালি কথা বলে না বলেই বুড়ির এত প্রিয়। কোন কারণে বাড়িতে লোকজন বেশি বেড়াতে এলেই বুড়ির সুবিধে। তখন ওর কথা কেউ মনেই করে না। বুড়ির মনের অনুকূলে সব ঘটনা ঘটে বলেই বুড়ি দ্রুত মানসিক পরিণতিতে পৌছে গেল।
কৈশোর ফুরোবার আগেই বাবা মারা যায়। বুড়ি কিছু বুঝতে পারে না। বাবার অভাব ওকে তেমন কষ্ট দেয়নি। বাবাকে কবরে নিয়ে যাবার আগে মুখের কাপড় সরিয়ে যখন সবাইকে দেখতে ডেকেছিল বুড়িও গিয়েছিল। বাবাকে অন্যরকম লাগেনি ওর। ঘুমিয়ে থাকলে যেমন লাগত ঠিক তেমন। অন্য সবাই কেঁদেছিল দেখে ও নিজেও কেঁদেছিল। কিন্তু তীব্র বেদনাবোধ কোথাও ছিল না। কেননা বাবার খুব কাছে ও কোনদিন যেতে পারেনি। বাবাকে কেন্দ্র করে তেমন কোন গভীর অনুভূতি নেই। ভালো একটা স্মৃতিও না। অবশ্য সেজন্য বুড়ির কোন দুঃখ নেই। বরং অনাদর অবহেলায় দিব্যি বড় হচ্ছিল বলে বাবা থাকা না থাকায় বুড়ির কোনো রদবদল হয়নি। মাঠে মাঠে ঘুরে, বৈঁচি কুড়িয়ে, ধানের ছড়ায় কেঁচড় ভর্তি করে, বিলের জলে সাঁতার কেটে বুড়ির অনাদরের দিনগুলো রাতের আকাশে তারার ফুলকি। বাবার প্রয়োজন বুড়ির জীবনে কোনো দাগ কাটেনি। মাঝে মাঝে ভাবত–বাবা হয়তো জানেই না যে বুড়ি নামে তার কোনো মেয়ে আছে। বাবার স্নেহের পরোয়া করেনি ও। তার চাইতে অনেক ভালো বাইরের জগতের হাতছানি। মাঠঘাট, ঝোপঝাড়, পথ-প্রান্তরের ডাক বুড়ির নাড়িতে নাড়িতে। এমনি করে সবার অলক্ষ্যে সংসারের নিয়মের গণ্ডির বাইরে বুড়ি ছিটকে পড়ে।
কৈশোর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিপত্নীক চাচাতো ভাই গফুরের সঙ্গে বিয়ে হলো বুড়ির। গফুরের বয়স নিয়ে মা-র একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু পিতার অবর্তমানে অভিভাবক বড় ভাইর কাছে সে আপত্তি টেকেনি।
তোমার ঐ দস্যি মেয়েকে কে সামলাবে মা? এতোদিন ছোট ছিল লোকের চোখে পড়েনি কিন্তু দিন দিন তো ধিঙ্গি হচ্ছে। শেষে একটা কেলেঙ্কারি না হলে বাঁচি!
বড়ভাই রেগে গিয়েছিলেন। মা বুড়ো হয়েছেন। কার কাছেই বা জোর খাটাবেন। তবু বুড়িকে একটু বুঝতে চেয়েছিলেন কিন্তু ক্ষমতা ছিল না তাঁর। মা-র বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে হয়তো খারাপ লেগেছিল তাই বড়ভাই গলা নরম করে বলেছিলেন, গফুরের সঙ্গে বিয়ে হলে খারাপ হবে না মা। তাছাড়া আমাদের চোখের ওপরই তো থাকবে। ভীন গায়ে বিয়ে দিয়ে চিন্তার শেষ থাকবে না। ওর যা স্বভাব! বাপ দাদার মুখে কালি দেবে।
মা চুপ করেই থাকলেন। বড়ভাই নিজের রায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বুড়িকে কোনরকম একটা বিয়ে নামক বন্ধনের মধ্যে ঠেলে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য। বুড়ির স্বভাব এবং আচরণ কোনটাই তার পছন্দ ছিল না। দেখেশুনে বুড়ি নিজেই চুপচাপ ছিল। বড়ভাইর হাতে-পায়ে ধরতে ওর বাধলো। তাছাড়া নিজের মনের কাছে অন্য কারো ঠাই নাই যার তার জীবনে স্বামী আর কতটুকু পরিবর্তন ঘটাতে পারবে? ও খুব একটা উৎসাহ পায় না। তেমন উত্তেজনাও বোধ করে না। শুধু বিয়েকে কেন্দ্র করে একটাই স্বপ্ন ছিল মনে। ভেবেছিল আর কিছু না হোক এক গা ছেড়ে আর এক গাঁয়ে যাওয়া যাবে অন্তত। একটুখানি পাগলা হাওয়া বাইরে যাবার ডাক শোনাত। হলদী গাঁয়ের বেড়িটা ভাঙতে পারবে। নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে ঘোমটার ফাঁকের বিমুগ্ধ দৃষ্টি ওকে স্বস্তি দেবে। কোন অপরিচিত জনের লোমশ হাত বুড়ির জীবনের বাঁকবদলের মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে। পানখাওয়া লাল দাঁতের হাসি ছাড়া বুড়ির জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু কোন ইচ্ছেই পূরণ হয়নি ওর। লাল নটে শাকের ক্ষেত, দোয়েলের লেজ দোলানো, শাপলার চিকন লতা, কচুরিপানার বেগুনি ফুল সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। এ সব কিছুই ওর জীবনের চারপাশে আছে ঠিকই কিন্তু কারো দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়ে নতুন করে দেখা হলো না।
চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ফলে উত্তরের ঘর থেকে দক্ষিণের ঘরে যাবার ছাড়পত্র পেয়েছিল মাত্র। তাছাড়া অন্য কোন বৃহৎ পরিবর্তন ওর মধ্যে আসেনি। গফুরের দুই ছেলে। বড়টি ছয় বছরের, ছোটটির বয়স চার। ওদের সঙ্গে বেশ একটা প্রীতির সম্পর্ক ছিল। ওদের কোলেকাখে করে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে অনেক। বিয়ের পর হঠাৎ করে ওদের মা হয়ে যাবার দরুন ভীষণ কৌতূহল হয়। কেমন অবাক লাগে। কখনো লজ্জা। ধুৎ কি বাজে ব্যাপার। দুটোকে ধরে পুকুরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। আবার কখনো নিস্পাপ কচি মুখ দুটো ভালো লাগে। তখন এক অস্থিরতায় ছটফটিয়ে ওঠে। এ ছাড়া আর সবই ওর দেখা জগৎ। পরিচিত শ্বশুর-শাশুড়ি, পরিচিত স্বামী, চেনা-জানা ঘরদোর, জানাশোনা পরিবেশ। সুতরাং কাউকেই নতুন করে চিনবার বা জানবার সুযোগ হয়নি। কেবল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে অনুভব করে একটা শক্ত লোমশ হাত ওকে আঁকড়ে ধরে আছে। তখন মনে হয় হ্যাঁ জীবনের কোথায় যেন কি ঘটে গেছে। আস্তে হাতটা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শশায়। কোন দিন চুপচাপ উঠে এসে বারান্দায় বসে থাকে। মনে হয় আরো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, সেটা হয়নি। অন্ধকার বাঁশবনে জোনাক জ্বলে, চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পড়ে। বুড়ির বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। কাঁদতে পারে না, ভুতুমের ডাক শুনে আবার ঘরে ঢোকে। বিছানায় উঠে আসে। গফুরের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। এর বেশি বুড়ির আর কিছু করার নেই। বুড়ি মানসিক দিক দিয়ে যতোই গণ্ডী লাফিয়ে পেরিয়ে যাক শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও কিছুতেই ডিঙোতে পারে না।