চম্পা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেখল আল্লারাখা প্রফেসরের সমুখে নতমুখে বসে আছে। ব্যাপার্টির চারমূর্তি রান্না করতে লেগে গেছে। আর ছোট সাকরেদ সামাদ বসে বসে জিনিসের লিস্টি মেলাচ্ছে। প্রতি শো-এর পর ওর হচ্ছে এই কাজ। তার কাছে গিয়ে বসল চম্পা। বলল, দে আমাকে, আমি দেখছি।
সামাদ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করল, শুনলাম, ঐ লোকটাকে দলে নেয়া হলো।
কে?
ঐ যে গোলাপ। ওস্তাদ বলতেই রাজি হয়ে গেল। দল ভাঙাতে এসেছে কি–না বুঝতে পারলাম না।
কেন?
ফটু করে রাজি হয়ে গেল কি–না। অনেকে ওরকম খেলা শিখে নিয়ে শেষে বারোটা বাজায়। নিজে দল করে। কাজটা বোধহয় ভাল করলেন না ওস্তাদ।
কিন্তু চম্পা একটুও অবাক হল না আল্লারাখাকে তার বাবা দলে নিয়েছেন শুনে। সে যে দল একদিন ভাঙতে পারে সে সম্ভাবনাও তাকে বিচলিত করতে পারল না। সামাদ এ সব বলে কয়ে চম্পার একটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে, দলের একজন বলে দুর্ভাবনার দাবি দেখাচ্ছে সেটাও চোখে পড়ল না চম্পার। সে বসে বসে জিনিসের লিস্টি মেলাতে লাগল। চম্পার মন ছিল না এখানে, কিংবা কোনখানে। নিজে সে জানতেও পেল না, একটা বিরাট হাই তুলল চম্পা।
আল্লারাখা খেল অত্যন্ত অল্প। প্রফেসর খেতে খেতে নিজে তাকে তুলে দিচ্ছিলেন, কিন্তু ফিরিয়ে দিল সে। ব্যাপার্টির চারমূর্তি অবাক হল, একটা মানুষ এতো কম খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে কী করে? এ যে একেবারে পাখির আধার! তাহোক, বাঁচলে পেট পুরে খেতে পারবে খাড়ানাক, বোচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো। সবার পরে ওরা খেতে বসবে। শোবার কিছু সঙ্গে নেই, প্রফেসর তাকে কালো আলখাল্লাটা বিছোতে দিলেন আর একটা বালিশ! চম্পার বদ অভ্যেস, দুটো বালিশ না হলে ঘুমোতে পারে না–তার একটা। একঘরে থাকতো সামাদ আর জহির। সামাদকে ব্যাপার্টির সঙ্গে শুতে বলে আল্লারাখাকে তার জায়গায় যেতে বললেন প্রফেসর। কিন্তু সে উত্তর করল, এইটুকু তো রাত। এই বলে সে বালিশ নিয়ে স্টেজের এককোণে শুয়ে পড়ল।
আস্তে আস্তে শেয়ালের ডাকে সাহস ফিরে এলো। তারা দল বেঁধে হাঁটতে লাগল বড় সড়কে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে বাঁশবনের এপার ওপার করতে লাগল, যেন এটা তাদেরই রাজত্ব। চোখ জ্বলতে লাগল, যেন কোন জ্ঞানী মানুষ মজার ব্যাপার দেখে হাসছে। রাত চৌকিদারেরা ঘুমিয়ে পড়ল লাঠি হাতে টর্চ কোমরে খুঁজে পথের এখানে ওখানে বসবার জায়গা খুঁজে নিয়ে। রেলইয়ার্ডে পানির ট্যাঙ্ক থেকে টপ টপ টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। একটা রাস্তা–তার এ মাথায় ঘুম আর ও মাথায় জাগরণ! আল্লারাখা একবার শেষ অবধি গিয়ে আবার ফিরে এলো এ মাথায়, আবার গেল, আবার ফিরে এলো, মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল, আবার চলতে লাগল, গেল, ফিরে এলো, গেল, আবার ফিরে এলো।
বালিশে মৃদু সুবাস। অনেক রাত ধরে পরতে পরতে জমেছে, জড়িয়ে গেছে। দুএকটা দীর্ঘ চুল লেগে আছে এখনো। আল্লারাখার ঘুমন্ত গালের নিচের সেই চ্যুত চুলগুলো শিরশির করে নদীর মতো সচল হয়ে উঠছে। আর সেই সুবাস; বোঝা যায় কি যায় না, হয়তো নেই। কোন ফুল, গাছ, পাতা কারো নয়। বোধহয় এরকম সুবাস থেকে আসে তার গোলাপের সুগন্ধ। আল্লারাখা আবার সেই রাস্তাটা দিয়ে বিলের মতো চলতে শুরু করল।
চোখ খুলে দেখল মাথার ওপর ঝুঁকে পড়ে চম্পা দাঁড়িয়ে আছে। আর চম্পা দেখল, স্টেজের এককোণে, ধূলোভর্তি পাটাতনে কুকুরের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে লোকটা। আল্লারাখা তখন তার বালিশের পরতে পরতে জড়ানো সুবাসের কথা জানতে পারল। চম্পার মনে হল লোকটার মতো একা আর কেউ নেই– এ একাকীত্ব এতে নিবিড় যেন একটা জামা, যা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে সে। তাই তার ইচ্ছে করলেও সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, স্পর্শ করতে পারল না, কথা বলতে পারল না। চম্পার মনে হল, তার ঘুমের ভেতর থেকে তাকে ডেকে এনেছিল লোকটা, এখন কাজ হয়ে গেছে, এখন সে যেতে পারে। সে চলে গেল। তখন আল্লারাখা হাঁটতে হাঁটতে সেই রাস্তার শেষ মাথায় ঘুমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সারারাতে আর একবারও ফিরে এলো না।
.
কুড়িগ্রামে একদিনের বদলে আরো তিনদিন শো করতে হলে প্রফেসর নাজিম পাশাকে। এন তার শো–এর সব সেরা ও শেষ আইটেম রক্তগোলাপ। ডাকবাংলোর রাস্তায় যেতে পড়ে ছবিঘর, সেটা প্রায় বন্ধ হবার জোগাড় হল। সবাই টাউন হলে আসছে ম্যাজিক দেখতে। রাতারাতি গজিয়ে গেছে চা–পান বিড়ির দোকান। লোক আসছে বন্যার মতো নাগেশ্বরী, ভোগডাঙ্গা, পলাশবাড়ি, কালিগঞ্জ, কাঠাবাড়ি, রাজার হাট, সিন্দুরমতি– কোন গ্রামের আর কেউ বাকি রইল না। লালমনিরহাটে বায়না হয়েছিল, কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনদিনের দিন রওয়ানা হতে হল প্রফেসরকে। পর পর বায়না রয়েছে রংপুর, নীলফামারী, বামনডাঙ্গা, গাইবান্ধা, বগুড়া, শেরপুর হয়ে পাবনা, উল্লাপাড়া আর কিশোরগঞ্জে।
এর মধ্যে চম্পার জেদে নাম পাল্টাতে হয়েছে আল্লারাখাকে। সেই বৃষ্টি বিকেলের পরদিনই। নাম শুনে হি হি করে হেসেছিল চম্পা, নতুন নাম দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেল সে। অবশেষে প্রফেসরই বাচালেন। দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ জেগে উঠে হাঁকডাক শুরু করে দিলেন, চম্পা চম্পা। হয়ে গেছে।