হঠাৎ লোকটা যেন খ্যাপা হয়ে গেলে। পাগলের মতো যেখানে হাত দিল সেখান থেকেই বেরুল গোলাপ। সে ছুঁড়ে দিতে লাগল গোলাপ জনতার মধ্যে। একশ, দুই শ, তিন শ, শত শত। তার আর শেষ নেই। চেয়ার, টুল, দরোজা, চুল, কান, আস্তিন, মেঝে– সারা হল থেকে বেরুচ্ছে গোলাপ। জনতার মধ্যে নেমে এসে সবার শরীর স্পর্শ করছে আল্লারাখা, আর বেরিয়ে আসছে গোলাপ। সবার হাত ভরে গেল, পকেট উপচে উঠল, সারা হল সুগন্ধে মম করতে লাগল– তবু শেষ হল না। বিদ্যুৎগতিতে চলছে আল্লারাখার দশ আঙুল, যেন এক সঙ্গে অনেকগুলো পাখির ডানা ঝটপট করছে আর তা থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তগোলাপ।
২. সে রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে
সে রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে লোকেরা বলাবলি করল দুহাজার। অনেকে বলল, কম করে হলেও চার হাজার গোলাপ। তারা বাড়ি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল দশ হাজারে। সারা রাত ধরে চলল তাদের মধ্যে এই আলোচনা। গর্বের সঙ্গে প্রত্যেকে দেখল তাদের বাড়ি নিয়ে আসা একেকটা গোলাপ। দশ হাজার গোলাপ তারা দেখে এসেছে। কিন্তু একমাত্র আল্লারাখা ছাড়া আর কেউ জানে না, আসলে সে মাত্র সাতশ ছিয়াশিটা গোলাপ এনেছিল।
লোকেরা কেউ একটা দুটো পাঁচটা যে যেমন পেরেছে গোলাপ নিয়ে এসেছে বাড়িতে তাদের বউকে ছেলেমেয়েকে পড়শিকে দেখাবে বলে। কিন্তু সবাই ভাগ্যবান নয়, সবাই আনতে পারেনি। কেবল যারা প্রথম এসেছিল তারাই পেয়েছে। বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোলাপের খবর সারা শহরে, আর দলে দলে লোক চারদিক থেকে এসে ভিড় করেছিল টাউন হলের দরোজায়। সে রাতে প্রফেসর নাজিম পাশাকে দুটো শো করতে হয়েছিল। একেকটা শো ছিল লোকে লোকারণ্য, কতো লোক প্যাসেজে, পেছনে, দরোজায় দরোজায়। দাঁড়িয়ে থেকে খেলা দেখে গেছে। ক্যাশ বাকশ ভরে উঠেছে পয়সায়, চম্পাকে দুবার এসে ট্রাঙ্ক খুলে ক্যাশ বাঁশ ঢেলে খালি করতে হয়েছে। টিকেট ইসু করতে করতে সামাদ আর পটকার হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে। সবাই গো ধরেছে–আমরাও গোলাপ চাই।
কিন্তু আল্লারাখা জানে একদিনে সাতশ ছিয়াশিটার বেশি গোলাপ সে বের করতে পারবে না। স্বপ্ন, বাস্তব, মায়া, বিভ্রম, বস্তু সব কিছুরই একটা সীমারেখা কোথাও না কোথাও আছে। আল্লারাখা বলল, কাল সে আবার গোলাপ দেবে সবাইকে।
লোকেরা তখন চেপে ধরল, কাল শো করতে হবে প্রফেসরকে। কথামতো আজকেই ছিল এ শহরে তাঁর শেষ প্রদর্শনী, কিন্তু তিনি রাজি হয়ে গেলেন। প্রফেসর দত্ত–র দল থেকে বেরিয়ে এসে নিজে দল করে অবধি একরাতে এতো টাকার টিকেট বিক্রি আর কখনো হয়নি। এবার ইসলামপুরে রহমান দর্জির সুট কাটা বাবদ মজুরি তিনি শোধ করতে পারবেন, জিনিসপত্র বানিয়ে আরো কয়েকটা নতুন আইটেম ঢোকাতে পারবেন শো–এ। চম্পাকে আসল সোনার গয়না বানিয়ে দিতে পারবেন। আজকাল সিনেমার পাল্লায় পড়ে ম্যাজিকের মজা কমে গেছে লোকের কাছে। কিন্তু আজকের কাণ্ড দেখলে কে বলবে সে। কথা? জনতাই দাবি করছে অতিরিক্ত শো–এর, হলে লোকের কুলান হচ্ছে না, দূর দূর গাঁ থেকে মানুষ পিঁপড়ের মতো আসতে শুরু করছে। আল্লারাখা স্টেজে দাঁড়িয়ে বলল, কাল। আবার সবাইকে গোলাপ দেবে সে। লোকেরা শুনে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
জহির নাক কুঁচকে বলল, মেসমেরিজম! সব মেসমেরিজম! এর আবার কেরামতি কী? ছোঃ।
চম্পা পাল্টা আক্রমণ করল, তো হয়েছে কী? হলই বা মেসমেরিজম।
জহির তার ঠোঁটে কামড়ের জ্বালাটা ভুলতে পারেনি তখনো, তার ওপরে চম্পার আল্লারাখার দিকে টেনে কথা বলা! থুক করে সে থুতু ফেলে বলল, তুই তো বলবিই। তোর বাপের টাকে পয়সা উঠছে কি–না! বাপের ব্যাটা হয় হাতের গুণে হয়কে নয় করুক, বুঝি তা হলে। মেসমেরিজম করে কারদানি। ও করলে আমিও এক্ষুনি ধানের ক্ষেতে জাহাজ চালাতে পারি।
চালাও না দেখি! চম্পা বিদ্রূপ করে বলল।
তোর কথায় আর কী! ওস্তাদের নিষেধ আছে। বাহাদুর হওতো নিজের দুখানা হাত দিয়ে খেল দেখাও। মেসমেরিজম তো ছোট জাতের কারবার। বাপ বেটিতে তাই দেখেই চিত্তির! কথা বলার ধরন দেখে হি হি করে হেসে উঠল চম্পা। বুঝল, খুব হিংসে হয়েছে জহিরের। একটা কিছু যে তাকে কাবু করতে পেরেছে এইটে মনে করে চম্পার ভেতরটা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। তাকে খানিকটা খোঁচাতে, খানিকটা মজা করতে হাত বাড়িয়ে বলল, বুঝলাম। একটা সিগারেট দেখি এবার।
গরগর করতে করতে জহির সিগারেট বার করে দিল! এ রকম আকস্মিক মোড় নেবে কথার, তা সে ভাবতে পারেনি। কেমন আমতা আমতা করতে লাগল। নিজের ওপরেই রাগ হল ভীষণ। তার ওপর ঠোঁটের নিচে দাঁতের দাগ এখনো কালো হয়ে আছে।
আগুন নেভাতে গিয়ে চম্পাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল সে আচমকা। চম্পা নিচু গলায় গর্জন করে উঠল, ছাড়ো। কিন্তু ছাড়ল না জহির। তারা দাঁড়িয়েছিল স্টেজের পেছনে ঝোলান কালো পর্দার নিচে। সেখানে অন্ধকারে দুম করে একটা শব্দ হল শুধু। কাঠের পাটাতনের ওপর ভারি দুটো শরীর পড়ে যাওয়ার শব্দ। হির তাকে বুকে চেপে ধরে গড়াতে গড়াতে কালো পর্দার ধুলো–ভর্তি ভ্যাপসা–গন্ধ ভাজের নিচে সেঁদিয়ে গেল। চম্পার মনে হচ্ছিল পাজর কখানা যেন গুঁড়িয়ে যাবে।
ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।
চুপ।
তার মুখ চেপে ধরল জহির। তারপর একটা মাত্র অস্বস্তিকর মুহূর্ত। চম্পার সমস্ত শরীর যেন অবশ আর অচেনা হয়ে গেলে সেই মুহূর্তে। সারা শহর আজ বিকেলের হঠাৎ বৃষ্টিতে যেমন হয়ে গিয়েছিল, অবিকল তেমনি। একবার শুধু জহির দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, দ্যাখ, কাকে বলে মেসমেরিজম! চম্পা, তুই আমার বউ হবি?