কোলাহল শুনে মনে হল, ওরা এবার হলের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। স্পষ্ট গলা শোনা যাচ্ছে নাজিম পাশা– ধ্বংস হোক। এমনকি স্টেজের ওপরেও দুপদাপ শুরু হয়ে গেছে। চড়চড় করে পর্দাটা ছিঁড়ে পড়ল বুঝি।
হঠাৎ সব চুপ। বিশ্বাস হল না প্রফেসরের। ভাবলেন, তাঁর কান খারাপ হয়ে গেল নাকি? চম্পার মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন, চম্পাও অবাক হয়ে মাথা তুলেছে।
সত্যি, একেবারে নিঃশব্দ। পিন পড়লেও শোনা যাবে। কী ব্যাপার? থেমে গেল কেন সব? পুলিশ?
গ্যালারির নিচে লুকিয়ে ছিল জহির, সেও হামাগুড়ি দিয়ে বেরুল। ব্যাণ্ডপার্টির চারমূর্তি ঘরের খিল খুলে উঁকি দিল।
সাজঘর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর আর চম্পা।
তারা সবাই দেখল, স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আল্লারাখা। আর জনতা সারা হলে যে যেখানে ছিল স্থাণুর মতো স্থির হয়ে আছে। হ্যাঁজাকে তেল পোড়ার সুমসুম শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
প্রফেসর কি স্বপ্ন দেখছেন?
চম্পার কপালের ওপর চাঁদের মতো আবার সেই একগুচ্ছ চুল লাফিয়ে পড়ল।
বিস্ময়ে চোয়াল স্কুলে পড়ল জহিরের।
আল্লারাখা এক হাত তুলল, সময় নিয়ে সবার চোখ বুলিয়ে আনল, তারপর সেই মেঘের মতো কণ্ঠ ধ্বনিত হল সারা হলে।
দেখুন, এটা আপনাদের নিজেদের ক্ষতি। নিজেদের টাউন হল নিজেরাই ভাঙছেন, আপনাদের যা বলবার আছে বলুন, হৈচৈ করবেন না।
কেউ কোন উত্তর দিল না।
বলুন।
কেউ নড়ল না। যেন কারো আর একফোঁটা শক্তি নেই মনে কিংবা শরীরে। এমনকি অনেককে লজ্জিত দেখাল, বিব্রত মনে হল।
তাহলে আপনাদের কিছু বলবার নেই? আল্লারাখার গম্ভীর কণ্ঠ আবার বৃথাই ঘুরে বেড়াল সারা হলে। তখন সে স্টেজ থেকে চলে যাবার জন্যে মুখ ফেরাল।
জনতার একজন হঠাৎ কথা বলে উঠল। থামল আল্লারাখা।
বিষ্টিতে আমাদের জিনিশপত্র সব ভেসে গেছে। নৌকাডুবিতে মরেছে তেরোজন। মসজিদের ছাদ ভেঙে পড়েছে।
তখন আরেকজন যোগ দিল, শুনছি, রেল লাইন ডুবে গেছে, আজ আর ট্রেন আসবে না।
হাটে যারা দোকান দিয়েছিল, সব ভেসে গেছে রাস্তার ফকির হয়ে গেছে বড় বড় ব্যাপারীরা।
এবার কয়েকজন একসঙ্গে বলল, এ মওসুমে কোনদিন এমন বিষ্টি হয় না।
আল্লারাখা সবার কথা শুনল। এক বুড়ো এবার ভিড় ঠেলে কাছে এলো তার। চোখে বোধহয়। ভাল দেখতে পায় না। চোখ পিটপিট করে সে বলল, এ বিষ্টি তো আসবার কথা না বাবা। যাদুতে কী না হয়? এ যাদুর কীর্তি। তোমাদের কীর্তি। আমি বাবা অনেক দেখেছি। কাল তোমরা এসেছ, আর অমনি ঝড় তুফান।
সবাই হৈহৈ করে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ সব যাদু চলবে না। টাকা দিয়ে যেতে হবে। কই হে, কার কতো বলো।
ভিড় হঠাৎ এগিয়ে আসছিল, আল্লারাখা হাত তুলতে সবাই থেমে গেল। উইংসের আড়াল থেকে চম্পা ফিসফিস করে বলল, বাবা, লোকটার কথা ওরা এতো শুনছে কেন? কী জানি। বোধহয় কিছু জানে?
প্রফেসর আর চম্পার দৃষ্টি বিনিময় হল, যার অর্থ একমাত্র যাদুকরেরাই বোঝে।
আল্লারাখা তখন বলে চলেছে, শুনুন, বিষ্টি এনে প্রফেসর নাজিম পাশার কোন লাভ নেই। বরং বিষ্টি হলে তার শো হবে না। বিষ্টি দেখে তিনি নিজেও খুব মন খারাপ করেছিলেন। তারই তো ক্ষতি। আজ হাটের দিন, আজ অনেক দূর থেকে সবাই আপনারা আসবেন, বিষ্টি এনে নিজের শো নষ্ট করে তার কী লাভ?
এ কথার জবাব কেউ দিতে পারল না। এবারে সবাইকে উসখুস করতে দেখা গেল বেরিয়ে যাবার জন্যে। মাথা নিচু করে ফেলেছে জনতা। যে বুড়োটা স্টেজের কাছে এসেছিল সে আমতা আমতা করতে লাগল।
আপনারা বলছিলেন প্রফেসর নাজিম পাশা লুকিয়ে আছেন। মিথ্যে। তিনি আপনাদের সামনেই আছেন। দেখুন।
আল্লারাখা থামবার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্টেজে এসে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তার পেছনে চম্পা। চম্পার পর জহির, সামাদ, ব্যাপার্টির চারমূর্তি। জনতা হাততালি দিয়ে উঠল একসঙ্গে। হাসিতে ঝলমল করে উঠল প্রত্যেকের মুখ। তরঙ্গের মতো উঠতে পড়তে লাগল হাততালির শব্দ। উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠল টাউন হল।
দেখুন, এটা কী?
গোলাপ। শখানেক কণ্ঠ উত্তর দিল একসঙ্গে।
আল্লারাখার হাতে একটা গোলাপ। লাল, তার ভারি সুগন্ধ, বিরাট। এক মুহূর্ত আগে গোলাপটা কোথাও ছিল না, সে একবারও হাত পকেটে ঢোকায়নি, তবু কোত্থেকে তার হাতে এলো কেউ ভাবল না। যেন সারাক্ষণই ওটা তার সঙ্গে ছিল। তখন আল্লারাখা চম্পার কপালের ওপর লুটিয়ে পড়া আধখা চঁড়ের মতো চুলের গুচ্ছ স্পর্শ করল– আরেকটা গোলাপ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।
হাততালি দিয়ে উঠল জনতা। এবারে আরো প্রবল। চমকে উঠল চম্পা। এ–কী? তার সারা শরীর এক নিমেষে গোলাপের সুবাসে ভরে উঠেছে। বিস্ময় নিয়ে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল আল্লারাখার দিকে।
আল্লারাখা তখন প্রফেসরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রফেসর একবার বিব্রত হয়ে হাসতে চেষ্টা করলেন। সে বলল, আপনার কাছেও অনেক গোলাপ আছে! দিন এরা অনেক দূর থেকে এসেছে। খুশি হবে। তবেই তো ওরা জানবে, আপনি ওদের ভাল চান। প্রফেসর প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলেন। তার পকেটে গোলাপ আসবে কোত্থেকে?
তখন আল্লারাখা মাফ করবেন বলে প্রফেসরের পকেটে হাত ঢোকাল, বের করে আনল একমুঠো গোলাপ। রক্তের মতো টকটকে লাল, তাজা, যেন এইমাত্র বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে। সুগন্ধে ভরে গেল সারা স্টেজ। চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল আল্লারাখার মুখ।