এতোক্ষণে চম্পার মনে পড়ল কপালের ওপর একগুচ্ছ চুল তখন থেকে সুড়সুড় করছে। সেটাকে হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে তার চোখে চোখ পড়ল আল্লারাখার। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চম্পার দিকে।
আবার মেয়েছেলের দিকে চোখ! জহির ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল আল্লারাখার গালে।
যেন আগুন ধরিয়ে দিল কেউ। চোখের ওপর থেকে চম্পার চেহারা মুছে গেল। আল্লারাখা ঘুরে পড়তে পড়তে কাঠের মোটা থামের সঙ্গে মাথা ঠুকে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ফুলে উঠল কপালের বাঁ দিক টোম্যাটোর মতো।
প্রফেসর আর্তনাদ করে উঠলেন, চম্পা, ওকে মারিস নে। মরে যাবে যে। আবার সেই শব্দহীন কান্না।
চম্পা বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোথায় মারছি!
আল্লারাখা একবার আকুল হয়ে প্রফেসরকে দেখবার চেষ্টা করল ব্যথা ভুলে। কিন্তু ভয় করল আবার যদি চম্পার দিকে চোখ পড়ে তার। পটকা আর বোচানাক তাকে টেনে তুলল পায়ের ওপর। কপালটা দেখে দুজনে দাঁত বার করে বলল, মাথা ফাটেনি ওস্তাদ। অ্যাকটিং করছে।
জহির তখন গজরাচ্ছে, মারবে না, শালাকে সোহাগ করবে।
জহিরের মুখের কথা মাটিতেও পড়তে পায়নি, এমন সময় বাইরে একটা প্রচণ্ড হৈচৈ ফেটে পড়ল। অনেকগুলো তোক একসঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করছে আর টাউন হলের টিনের বেড়ায় পড়ছে দমাদম ইট–পাটকেল। আল্লারাখার হাত ছেড়ে দিয়ে পটকা কানখাড়া করে বলল, কী যেন শুনছি? ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেল।
ভয় পাবার কথাই। শখানেক লোক কোত্থেকে একসঙ্গে হয়েছে, অন্ধকারে তাদের ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, রাস্তাটা ভরে গেছে, শুধু চিৎকার শোনা যাচ্ছে আর ইট–পাটকেল। ভেঙে পড়া প্ল্যাকার্ডটার ওপর কয়েকজন বেদম নাচছে আর লাথি মারছে। আবার কেউ আমলকি গাছ বেয়ে উঠে গেছে ওপরে, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ল হলের ছাদের ওপর। বিকট একটা শব্দ হল।
বেরিয়ে আয় ম্যাজিকের বাচ্চা। বেরিয়ে আয়। ঘুড়িটা গেল কোথায়? কোন ভাগাড়ে মরল সব? চালাকির জায়গা পাওনি বদমাশ!–এই রকম সব হাঁকডাক চলছে। কেউ আবার চিৎকার করে উঠছে, নাজিম পাশা–সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করছে সবাই ধ্বংস হোক। আরেকবার একজন হাক দিল কুড়িগ্রাম– আবার সমবেত চিৎকার ছাড়তে হবে। কে যেন এরিমধ্যে ফোড়ন কাটল, যাদু মেরে হাওয়া হয়ে গেল নাকি বাপ! অমনি দুপ-দাপ পড়তে লাগল ইট। ছাদে যে লোকটা লাফিয়ে পড়েছিল সে উপুড় হয়ে কঁকিয়ে উঠল, আমি ভাই আমি। একটা ঢিল এসে লেগেছে তার। কিন্তু তার কণ্ঠ কেউ শুনতেই পেল না।
জহির উঁকি মেরে ব্যাপার দেখেই ছুট দিল। হাঁফাতে হাঁফাতে প্রফেসরকে গিয়ে খবর বলল, পাবলিক খেপেছে।
হ্যাঁই! পাবলিক খেপেছে? কেন?
কী জানি!
প্রফেসর তিরিশ বছর ধরে ম্যাজিক দেখিয়ে খাচ্ছেন। লোকের নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা। কিন্তু তিনিও যেন ঘাবড়ে গেলেন আজ। কারণ, কোন কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি কেন ওরা খেপতে পারে। কাল রাতের শো–তো চমৎকার গেছে। আর আজ শো হলই বা কোথায় যে ওরা খেপবে? বেওকুফের মতো তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন দলের সবার দিকে।
চম্পা বলল, জহির তুমি একবার যাও না, দেখে এসো কী ব্যাপার।
প্রফেসর যেন এই সোজা কথাটাই এতোক্ষণ মাথা থেকে বার করতে পারছিলেন না। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, হ্যাঁ চম্পা, ও যাক, দেখে আসুক।
দড়াম করে একটা ইট এসে পায়ের কাছে দশ টুকরো হয়ে ছিটিয়ে পড়ল।
ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি নিমেষে অন্তর্হিত হল ঘরের মধ্যে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর। তারপর চম্পার দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলেন, চম্পা, শিগগীর ঘরে যা, খিল দে। পরমুহূর্তেই ফাঁকা হয় গেল বারান্দা।
একা আল্লারাখা দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে, কেউ তাকে লক্ষও করল না। বাইরে যে এভোবড় একটা গোলমাল চলছে তার যেন কোন প্রতিক্রিয়াই নেই আল্লারাখার মুখে। সে নিঃশব্দে তার ডান হাতের আঙুলগুলো চোখের সামনে তুলে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
বাইরে একজন হঠাৎ হৈহৈ করে উঠল, ঐ যে ঐ বেরিয়েছে।
সবাই তখন চোখ তুলে দেখে দোতলার বারান্দায় এক মূর্তি; জহির এসে দাঁড়িয়েছে ওপরতলায় মেয়েদের গ্যালারির পাশে ছোট্ট ঝোলানো বারান্দায়। ক্ষীণকণ্ঠে সে দুহাত তুলে বলল, শান্ত হোন ভাইসব! ভাইসব, আপনারা শান্ত হোন।
সবাই একটু চুপ করল। এক মুহূর্তের জন্যে। কে একজন বলল, আরে, এটা তো সাকরেদটা। সঙ্গে সঙ্গে আবার গোলমাল শুরু হয়ে গেল।
সাহস থাকে, তোর ওস্তাদকে বেরিয়ে আসতে বল।
মার, মার শালাকে।
আবার উড়তে লাগল থান ইট! জহির কোনরকমে দৌড়ে পালাতে গিয়ে অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নষ্ট করবার মতো সময় নেই। তক্ষুনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গ্যালারির দরোজাটা বন্ধ করে হাঁফাতে লাগল সে।
সাজঘরে প্রফেসর চম্পাকে জড়িয়ে ধরে ঠক ঠক করে কাঁপছিলেন। এ শহরে কি পুলিশ নেই? আইন নেই? তার মনে হচ্ছিল যেন এ যান বাচলেও বিশ্বাস হবে না, বেঁচেছেন। চম্পাকে ডাকাতি করে নিয়ে যাবে নাকি? ভরসা কী! যোয়ান মেয়েছেলে, তার ওপর শো এর মেয়ে, কোন কর্তার চোখ পড়েছে আল্লা জানে। প্রফেসর বিড়বিড় করে চম্পাকে বললেন, ভয় করিস না চম্পা। ভয় করিস না। দরজা বন্ধ আছে।
কিন্তু চম্পারও ততোক্ষণে ভয় করতে শুরু করেছে। ছাদের ওপর পর পর দুটো ইট এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাঙ্কের ওপর বসে পড়ল বাপ মার মেয়ে।