লোকটা ফিরে তাকাল চম্পার দিকে। অস্পষ্ট একটা হাসিতে এক পলকের জন্যে মুখটা আলো হয়ে উঠল তার। এক হাতে বিশেষ কোন দিকে না দেখিয়ে, যার মানে যে–কোন দিকে হতে পারে, বলল, ওদিকে। তার কণ্ঠ শোনান অদ্ভুত, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটা গম্ভীর ঘে। সে কণ্ঠ সবাইকে অবশ করে দিয়ে গেল। বিশেষ করে জহিরকে।
লোকটা চম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, বিষ্টিটা এখুনি যাবে। আমি দেখে এসেছি, ওদিকে আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে।
ওদিকে বলতে কোন দিক বোঝাল কে জানে। হঠাৎ সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, এ–কী! তারা দেখা যাচ্ছে। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, বাতাস নেই– একেবারে ছবির মতো।
আকাশ থেকে তাড়াতাড়ি চোখ ফেরাল চম্পা। লোকটা তখন একমনে তার জামা শুকোচ্ছে আগুনে। কী একটা বলতে গেল চম্পা, পারল না। লোকটা এমন তন্ময় হয়ে আছে যে সাহস হলো না।
তাকে সম্ভ্রম করে পটকাও কেৎলিটা নাবিয়ে নিয়ে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তার পানিও গরম হয়ে গিয়েছিল; সে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল চা বানাতে। আর বৃষ্টি থেমেছে দেখে জহির তাড়াতাড়ি দৌঁডুল সাজঘরের দিকে।
সেখানে গিয়ে প্রফেসরকে সে পেল না। স্টেজে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানে তিনি একটা চেয়ারে বসে আছেন, পা দোলাচ্ছেন। তাকে গিয়ে বলল, বিষ্টি তো নেই!
নেই মানে?
ধরে গেছে।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। জহিরকে ধমক দিয়ে বললেন, তা হ্যাঁ করে আমার চেহারা দেখছো কী? সামাদ কই, ব্যাণ্ডপার্টি গেল কোন চুলোয়? বাজনা বাজাক, টিকিট ঘরটা খুলে দিচ্ছে না কেন? আমি মরে গেছি নাকি, বলে কী এরা, চম্পা–চম্পা।
আবার সেই ডাক। কিন্তু এ ডাক শুনতে পেল না সে এবার। সে তখন কথা জুড়ে দিয়েছে সেই লোকটার সঙ্গে, পটকা চা এনে দিয়েছে, চুমুক দিতে দিতে।
কী নাম?
আল্লারাখা।
হি হি হি।
আল্লারাখা তখন খাড়ানাকের সঙ্গে ড্রামটা আগুনের ওপর ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গরম করছে। চম্পাকে হাসতে শুনে এক পলক চোখ তুলেই নাবিয়ে নিল। তারপর নিচু গলায় কৈফিয়ত দিল, আমার সব ভাইবোনগুলো হতো আর মরে যেতো। তাই সবশেষে আমি যখন হলাম, মা নাম রাখলেন আল্লারাখা। আমি কী করব?
হি হি। বাহ নিজের নাম কেউ বদলাতে পারে না নাকি? আমার বাবাও নাম বদলেছে। তুমি বদলাবে?
লোকটা খুব উৎসাহী হয়ে উঠল। চম্পার দিকে হঠাৎ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধোল, আমাকে তোমরা নেবে?
নেবো মানে? হকচকিয়ে গেল চম্পা।
দলে।
না বাপু, আমাদের লোক দরকার নেই।
তাহলে নাম বদলে কী হবে?
তখন প্রফেসরের পেছনে এলো জহির। দেখেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।
এ লোকটা আছে এখনো? আঁ? চম্পা, এতো হাসি কিসের?
প্রফেসর কিছু বুঝতে না পেরে একবার চম্পার দিকে একবার লোকটার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন। আরো খিলখিল করে হেসে উঠল চম্পা।
বাবা, বলে নাম আল্লারাখা। হি হি হি।
লোকটা আগুনের ওপর ড্রামটা ধরে রেখে আড়চোখে দেখছিল চম্পাকে, তার কপালের ওপর আধখানা চাঁদের মতো দুলতে থাকা একগুচ্ছ চুল। আর ভাবছিল, সে পারতো, সে এক্ষুনি অবাক করে দিতে পারতো চম্পাকে, যদি চম্পার ঐ চুলের চাঁদ সে একটুখানি স্পর্শ করতে পারতো।
হাসির সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠছিল চম্পার কপালে সেই চুলের গুচ্ছ। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বুঝি আল্লারাখা। হঠাৎ এক অঘটন ঘটল। হাত থেকে ড্রামটা পড়ে গেল গনগনে আগুনে। ভাল করে বোঝার আগেই পটাস করে একটা শব্দ হল খোল ফেটে যাওয়ার, তারপর উঠতে লাগল চামড়া পোড়ার কটু গন্ধ।
হতভম্ব হয়ে গেল সবাই। বেওকুফের মতো উঠে দাঁড়াল আল্লারাখা। খাড়ানাক আর চালকুমড়ো ড্রামটাকে কোনরকমে তুলে বারান্দার নিচে বৃষ্টির জমা পানিতে ছুঁড়ে ফেলল।
ঝাঁপিয়ে পড়ে আল্লারাখার কলার চেপে ধরল জহির। তোকে ড্রাম ধরতে বলেছিল কে। বলেই এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল সে, যার টাল সামলাতে অনেকক্ষণ লাগল আল্লারাখার।
প্রফেসর বললেন, চম্পা, আমি বুঝতে পারছি না আমার ওপর এতো গজব কেন?
কী হয়েছিল, চম্পা থরথর করে কাঁপছিল। প্রফেসর তাকেই ধমকাতে লাগলেন, এখন ড্রামটাও পুড়ল। এইটার দাম কতো জানিন? আমাকে কাটলেও দশটা ফালতু টাকা বেরোবে না। কোত্থেকে এ উজবুক এলোরে? চম্পা?
পানিতে চুবিয়ে ড্রামটা আবার বারান্দায় তুলে এনেছে খাড়ানাক আর চালকুমড়ো। গোলমাল শুনে সামাদ, পটকা আর বোচানাকও ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সামাদ বলে উঠল, ব্যাটা মিচকে যেন কিছু জানে না। বোবা নাকি?
আল্লারাখা ড্রামটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর চম্পা আর প্রফেসরকে বলল, ফ্রেমটা বেঁচে গেছে। একটা খোল পেলে আমি ছেয়ে দিতে পারতাম। আশেপাশে সে তাকাল, যেন এখানেই কোথাও এক আধটা খোল পাওয়া যাবে।
হুংকার দিয়ে উঠল জহির, ছেয়ে দিতে পারতাম! শুয়ার কা বাচ্চা। তোর পিঠ থেকে চামড়া তুলে আমি খোল বানাবো আজ।
একটা কিছু নেই এখানে? আল্লারাখা বিড়বিড় করে বলল, যার অর্থ কেউ বুঝতে পারল না।
প্রফেসর ড্রামের কাছে উবু হয়ে বসে হাত বুলোতে লাগলেন পোড়া খোলর ওপর, যেন এক্ষুনি তিনি যাদুবলে ভাল করে দিতে পারবেন। মন্ত্র পড়ার মতো তিনি বলে চললেন, আমার কাছে বলে একটা পয়সা টাকার সমান। এটাকে ঢোকাল কে এখানে? কোত্থেকে এলোরে গরুটা। আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেলরে চম্পা।