আবার কী? হাটের দিকে যাবো, বৃষ্টি নাবলো। বলল খাড়ানাক। রাগটা তারই বেশি। কারণ ড্রামটা আঁচে ধরতে গিয়ে বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছিল তাকে।
চম্পা বলল, এই পটকা, ওর সঙ্গে হাত লাগা না। নবাব হয়েছিস?
সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ড্রাম নাবিয়ে চেঁচিয়ে উঠল খাড়ানাক, থাক, থাক, অমন কাজের কর্তা আমার দরকার নেই। চাই কী খোল শুদ্ধ দেবে পুড়িয়ে।
পটকা চম্পার ডাক শুনে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, আবার নিবিষ্ট মনে সে ভিজে হ্যাণ্ডবিল ছাড়াতে লাগল। হি হি করে হেসে উঠল চম্পা। একটা টুল টেনে জুৎ করে বসল তার ওপর। বলল, সবগুলোর মেজাজ একেবারে ছিপ হয়ে আছে। হি হি হি।
চালকুমড়োর একটু বুদ্ধি কম। সে হাঁ করে ভাবল খানিক, পরে জিগ্যেস করল, ছিপ মানে?
মানে?– বলছি। বলেই চম্পা একটা সরু ভাঙা ডাল হাতে তুলে নিয়ে এক মাথা ধনুকের মতো টেনে শন করে ছেড়ে দিল, চটাং করে গিয়ে পড়ল চালকুমড়োর পিঠে। তিড়বিড় করে উঠল সে ব্যথায়।
চম্পা বলল, এর নাম ছিপ। বুঝলি? এই পটকা। পটকা?
জ্বি।
থাক আর হ্যাণ্ডবিল ছাড়িয়ে কাজ নেই। চাট্টি খিচুড়ি রাঁধবার জোগাড় দেখ গে। আজ আর শো হবে না। আড়মোড়া ভাঙল চম্পা, যেন কদ্দিন ঘুম হয় না তার, আজ একটু ঘুমোবে। চারকণ্ঠ একসঙ্গে শুধোল, কেন, শো হবে না কেন?
বোঁচানাক বলল, বারে, আমরা তো বিলি কাগজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমাদের দোষ কী! দূর গাধা। চম্পা পা দিয়ে বোচানাকের পেটে খোঁচা দিল একটা। দেখছিস না বৃষ্টি, লোক হবে কোত্থেকে?
ওস্তাদ বলেছে?
আমি বলছি। না বাপু আর পারি না। এই খাদা, এক কেলি পানি দে–না চায়ের। বসে বসে খাই। আর আমার বালিশের নিচে একখানা পাউরুটি আছে, আনবি?
চম্পার ঐ একটা স্বভাব। এই চারমূর্তির সঙ্গে বসলে কথার খই ফুটতে থাকে। এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দেয় না কাউকে। আজ শো না হলে যে তাদের আসা যাওয়ার খরচই উঠবে না, খাবার পয়সা থাকবে না, সেটা যেন বেমালুম ভুলে গেছে চম্পা। সে ভাবনা করছেন একা স্টেজে পায়চারি করতে করতে প্রফেসর নাজিম পাশা, বারো বছর আগে যিনি তাঁর ওস্তাদ প্রফেসর জে, সি, দত্ত হিন্দুস্থানে চলে যাবার পরে নিজের নাম নাজিমুদ্দি ভূঁইয়া থেকে নাজিম পাশা বানিয়ে দল করেছিলেন।
খাড়ানাক এসে খবর দিল, পাউরুটি বোধ হয় ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে, পাওয়া যাচ্ছে না।
ইঁদুরে না তুই? তারস্বরে জানতে চাইল চম্পা। বল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?
জহির এসে বসল চম্পার গা ঘেঁসে আরেকটা টুল নিয়ে। বলল, থাক, আর রাগ করিস নি চম্পা। সিগারেট খাবি?
চম্পা তাকে কিছু বলল না, বলল খাড়ানাককে। যাক, আজ মাফ করে দিলাম। আর বলতে বলতে জহিরের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে গুজল। ম্যাচ জ্বালিয়ে ধরল জহির। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে চম্পা বলল, কী বাজে সিগারেট যে খাও। গন্ধে পেট মোচড়াতে থাকে। আরেকটা টান দিয়ে বলল, ঠাণ্ডাও নেহাত মন্দ পড়েনি।
তার সিগারেটের দুর্নাম শুনে জহির একটু মুখ শুকোল। রাগ ঝাড়ল পটকার ওপর। মাথায় তার চাটি মেরে বলল, হারামজাদা, চায়ের পানি বসাতে এতোক্ষণ?
চারমূর্তির মধ্যে পটকাই সবচে নিরীহ। কিন্তু তার চোখও জ্বলে উঠল জহিরের মার খেয়ে। অথচ মুখে কিছু বলল না, ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে চায়ের পানি আগুনে বসাল দুখানা ইট পেতে।
ঠিক তখন। একসঙ্গে চমকে মুখ ফিরিয়ে সবাই দেখে, বারান্দার নিচে তাদের পেছনে একটা মানুষ গাছের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে অন্ধকারে। নড়ছে না, শব্দ করছে না। বৃষ্টি আর অন্ধকারে ভাল করে ঠাহরও হচ্ছে না সত্যি সত্যি মানুষ, না আর কিছু।
কে? কে ওখানে? টুল থেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল জহির। বৃষ্টির এই ঠাণ্ডার জন্যে কি–না কে জানে, তার কণ্ঠ বড় দুর্বল আর ভাঙা শোনাল। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল চম্পা।
লোকটা তখন আস্তে আস্তে বারান্দায় উঠে দাঁড়াল! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সবাই। কেউ তাকে চেনে না, এর আগে কখনো দেখেনি। ওরা ভাবল, এ শহরের কেউ হবে হয়তো থানার দারোগার জন্যে দশখানা পাশ চাই, কী কোন কর্তা পাঠিয়েছেন জানবার জন্যে যে চম্পা রাতে নেমন্তন্ন নিয়ে থাকে কি–না। বড় অস্বস্তি বোধ করল চম্পা। কিন্তু সে এক
মুহূর্তের জন্যে। সবার ভেতরে চম্পাই প্রথম বুঝতে পারল, ওরকম প্রস্তাব নিয়ে যারা আসে তারা দেখতে আলাদা, তাদের চলন অন্যরকম এ লোকটার পোশাক সাধারণ, কিন্তু কেমন সুন্দর গায়ে–মানানো, চেহারা কিছু না, কিন্তু চোখ ফেরানো যায় না। শ্যাম বর্ণ লম্বাটে মুখের মধ্যে সবকিছু হারানো খোয়ানোর স্থির একটা ছবি যেন। যেন, লোকটা সারাক্ষণ কী ভাবছে তার কোন সমাধান হচ্ছে না, তাই ভারি অন্যমনস্ক।
জহির একবার দ্বিধা করল–তুমি না আপনি? জিগ্যেস করল, কী চাই?
লোকটা এবারও কোন জবাব দিল না। তার মোটা পাজামা থেকে পানি নিংড়ে শার্টের খুঁট দিয়ে মুখ মুছল। বড় পরিতৃপ্ত দেখাল তাকে তখন।
ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি তখন থেকে থ। জহির কিছু বুঝতে না পেরে চম্পার কাঁধে হাত রাখল, চম্পা সেটা সরিয়ে দিল কাঁধ নামিয়ে–কিন্তু দুজনের কারো মন ছিল না তাতে। তারা দেখছে লোকটাকে। আর লোকটা তখন হাঁটু গেড়ে আগুনের পাশে বসে হাত সেঁকছে। একমনে।
আর সহ্য হল না জহিরের। এতোক্ষণ কথার জবাব না পেয়ে মেজাজ সপ্তমে ওঠবারই কথা। হয়তো একটা কিছু করতে যাচ্ছিল, তার আগেই চম্পা হাতের সিগারেটটা আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধোল, থাকো কোথায়?