প্রফেসর চোখ তুলে তাকালেন। হাত আস্তে আস্তে নেবে এলো তার কোলের ওপর। দেখলেন, সন্ধ্যের শো–র জন্যে চম্পা মুখে রঙ মেখে একেবারে তৈরি। বাকি কেবল ড্রেস করে নেয়া। যে জানালা দিয়ে শোনা গিয়েছিল প্ল্যাকার্ড পড়ে যাবার শব্দ, সেদিকে অস্পষ্ট একটা হাতের ইঙ্গিত করে প্রফেসর বললেন, চম্পা, আজ বোধহয় শো হবে না।
তার কথায় সায় দিয়েই যেন কড় কড় দীর্ঘ একটা বিদ্যুত ডেকে উঠল দূরে দূর থেকে নিকটে।
এতো বিষ্টিতে কে আসবে?
দেখল, বাবার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে শব্দহীন কান্নায়। হঠাৎ কেমন মায়া হল চম্পার। বলল, তুমি কি জানো, বিষ্টি যেতে কতোক্ষণ? তা ছাড়া আজ এদের হাট। মফঃস্বল থেকে অনেকে আমাদের দেখবে বলে এসেছে। যতো রাতই হোক আসবে।
আসবে?
চম্পা সেদিকে কান না দিয়ে বলল, বরং শো এক ঘণ্টা পিছিয়ে দাও। আর তুমি এক্ষুনি গিয়ে স্টেজ গুছিয়ে ফ্যাল, ড্রেস করে নাও। সময় কই?
তার কথায় যেন কাজ হল। উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। পকেট থেকে রুমাল বের করে ফাঁচ করলেন একবার। চম্পা বলল, তোমার কোটের আস্তিন হয়ে গেছে।
ভাল। তারপর চোরের মতো তাকিয়ে হঠাৎ শুধোলেন, প্ল্যাকার্ডটা পড়ে গেল শুনেছিস?
হ্যাঁ।
আর কিছু না বলে তখন সাজঘরের দিকে চলে গেলেন প্রফেসর। চম্পা দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। এতোক্ষণে তার চোখে পড়ল, পাশের দরোজটা খোলা। ওঘরে চৌকির ওপর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে জহির। ঘুমোচ্ছে না, চোখ পিটপিট করে দেখছে চম্পাকে। আর তার পায়ের আঙুল মটকাচ্ছে সামাদ।
প্রফেসর চলে যেতেই তড়াক করে উঠে বসল জহির। বলল, চম্পা, শোন।
কী?
এদিকে।
চম্পা এলে জহির হাসল। বিরক্ত হয়ে চম্পা শুধোল, কী বলবে?
যা বৃষ্টি, সব ভেসে যাবে নাকি, অ্যাঁ?
যাক।
একটু চা হয় না চম্পা?
বানিয়ে নাও গে। আমি জানি না।
খপ করে হাত ধরে ফেলল জহির। তার কী ইশারা ছিল, সামাদ কেটে পড়েছে।
চম্পা, তোকে পায়রা বানিয়ে রাখতে পারি, থাকবি?
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চম্পা বলল, কোথায়?
আমার আস্তিনে।
বানাও দেখি কেমন ওস্তাদ!
চম্পার কণ্ঠে বিদ্রূপ ঝরে পড়ে। কিন্তু জহির সেটা বুঝতে পারে না। সে মনে করে, চম্পার মনটাও আজ বৃষ্টিতে হু হু করছে তার মতো। বলে, তাহলে চোখ বন্ধ কর।
করল চম্পা। সে জানে, এ রকম একটা সুযোগ হয় না। ঠোঁট তাই হাসিতে মাখা মাখা হয়ে ওঠে। জহির বলে, হাসছিস যে?
এমনি।
জহির চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকা চম্পার রূপ নিরিখ করে কিছুক্ষণ। মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ লাফিয়ে ওঠে তার। সারা শরীরের মধ্যে শুধু ঐ হাসি–হাসি–ঠোঁট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
প্রায়-চিৎকার করে ওঠে সে। মুখটা নাবিয়ে এনেছিল, চম্পা তার নিচের ঠোঁটে আচমকা দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। রক্ত পড়ছে। আর একটা চড়। খিলখিল করে হেসে উঠল চম্পা।
পায়রা! ইস, ওস্তাদ কতো? আয়না এনে দেবো, কেমন গাধার মতো দেখাচ্ছে?
স্টেজে নামবার জন্যে মুখে রঙ মেখেছিল চম্পা, তার খানিকটা লেগেছে জহিরের চিবুকে। তাই দেখে চম্পা লুটিয়ে পড়ল হাসিতে। হাসতে হাসতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেল সাজঘরের দিকে।
.
কিন্তু বৃষ্টি কমবার কোন লক্ষণই নেই। আস্তে আস্তে সূর্য অস্তাচলে গেল। তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আরো ভয় করতে লাগল সবার। মনে হল, সমস্ত পৃথিবীকে কোন এক অশরীরি শক্তি দুহাতে সংকুচিত করে শ্বাসরোধ করতে চাইছে। বিদ্যুতের মধ্যে দিয়ে তার দম্ভ, বৃষ্টিতে তার সংহারের সংকল্প, হঠাৎ নেমে আসা শীতের মধ্যে তার জয়ের উল্লাস লেখা।
হ্যাজাক দুটো ধরাল সামাদ। একটা সে রাখল স্টেজের ওপর, আরেকটা সাজঘর আর পাশের ঘরের মাঝখানে টুলের ওপরে, যেখানে বসে প্রফেসর একটু আগেই কাঁদছিলেন। হ্যাঁজাকের ফিনফিনে আলো থেকে ভ্রমরের মতো একটানা একটা গুঞ্জন সারা টাউন হলের ভেতরে ঘুরতে লাগল। প্রফেসর ড্রেস করে খামোকা পায়চারি করছেন খালি স্টেজে। চম্পা ড্রেস করেনি, সে একটা টুলের ওপর বসে অস্বচ্ছ চোখে বাবাকে দেখছে। আর জহির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের নিচে চম্পার দাঁতের দাগ পড়ছে একমনে। ছোট সাগরেদ সামাদ কী করবে বুঝতে না পেরে উবু হয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে আড়ালে। তার কোন কথা নেই, শো হোক আর না হোক, চম্পা জহিরকেই বিয়ে করুক আর হাতিকেই করুক, মাস কাবারে তার আশি টাকা পেলেই হল।
এমন সময় ভিজতে ভিজতে ব্যাপার্টির চারমূর্তি ভূতের মতো এসে হাজির খাড়ানাক, বোচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো। তারা এসে মহা গম্ভীর হয়ে রইল, কাউকে কিছু বলল না। পটকা বারান্দার এককোণে বাতাস বাঁচিয়ে আগুন করল খানিকটা; খাড়ানাক বসে বসে তার ড্রাম দুটো সেঁকতে লাগল সেই আগুনে। বৃষ্টির পানিতে একেবারে মিইয়ে গেছে। খোলটা। কিন্তু পরনের কাপড় ভিজে একসা সে–দিকে চোখ নেই। বোচানাক আর পটকা বসে বসে ভিজে হ্যাণ্ডবিলগুলো একটা আরে টার গা থেকে ছাড়াতে লাগল। আর চালকুমড়ো তার বিউগিল থেকে ঝাঁকিয়ে পানি বার করতে লাগল আর ক্ষণে ক্ষণে চোঙের মধ্যে চোখ লাগিয়ে পরখ করতে শুরু করল। এ যন্তর নিয়ে আবার ভারি মুশকিল। আগুনের আঁচ পেলে সোনালি কলাই উঠে তামা বেরিয়ে পড়বে।
চম্পা এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। এক মুহূর্তে দেখল ওদের কাণ্ডকারখানা। বিশেষ কাউকে লক্ষ না করেই সে জানান দিল, কী রে?