একবার কী হল, জহির তাক করে ছোরা ছুঁড়তে জানে, লক্ষ্য ফসকায় না এক চুল। বাবা বললেন, তাহলে একটা বোর্ডে কাউকে দাঁড় করিয়ে জহির তার দিকে তাক করে ছোরা ছুঁড়বে–ছোরাগুলো চারপাশে চোখ–মুখ–গা ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে বিধবে। কিন্তু মুশকিল হল জহিরের ছোরার সামনে দলের কেউ বোর্ডে দাঁড়াতে সাহস পেল না। ব্যাপাটির চারজন যারা শহরে বাজনা বাজিয়ে হ্যাণ্ডবিল বিলি করে, আবার শোর সময় টিকেট বিক্রি করে এসে ম্যাজিকের সঙ্গে বাজনা বাজায়, তাদের চারটে চমৎকার নাম দিয়েছিল চম্পা খাড়ানাক, বোচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো। ছোরার কথা শুনে খাড়ানাক চাকরি ছেড়ে দেবার হুমকি দেখাল, বোচানাক ক্রমাগত ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ল, পটকা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, আর চালকুমড়ো গড়াতে গড়াতে গুম হয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন একটা বুদ্ধি করলেন বাবা। খড় মাটি দিয়ে সুন্দর একটা কার্তিক বানিয়ে আনলেন কুমোরদের দোকান থেকে নগদ পনেরো টাকা দিয়ে। সেটাকে বোর্ডে দাঁড় করিয়ে জহিরের হাতে তিরিশটা ছোরা দিয়ে রিহার্সেল নেওয়া হল– দেখা গেল, চমৎকার তাক। একটাও মূর্তির গায়ে লাগেনি একেবারে গা ঘেঁষে বোর্ডে বিধছে। মূর্তিটা যখন সরিয়ে আনা হল, মনে হল, ছোরা গেঁথে গেঁথে কে যেন বোর্ডে আস্ত একটা মানুষের ড্রয়িং করে রেখেছে। এমনকি মূর্তির দুপায়ের মাঝখানে আধ ইঞ্চি ফাঁক– তার মধ্যেও তিনটে ছোরা বাঁট পর্যন্ত গাঁথা।
রিহার্সেল চলল কয়েকদিন। বায়না ছিল শান্তাহারে রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে। সেখানে স্টেজে নাবানো হল মূর্তিটাকে, জহির তাক করে চমৎকার ছুঁড়ে গেল একের পর এক তিরিশটা ছোরা। কিন্তু কেউ তালি দিল, উল্লাসে চিৎকার করে উঠল না। বরং শোনা গেল, লোকজন পটপট চেয়ারের হাতল ভাঙছে আর বলছে, মাটির মূর্তি দিয়ে ছোরার বাহাদুরি দেখানো হচ্ছে! হতো জ্যান্ত মানুষ, বুঝতাম কেমন ম্যাজিশিয়ান। দুত্তোর, বাজে, বাজে! সে রাতে আর খেলা জমল না, সবাই হৈচৈ করে বেরিয়ে গেল, টিকেটের দাম ফেরতের জন্যে। মহা হট্টগোল বাধল, ওদিকে রেলের লোক এসে উনিশখানা চেয়ারের হাতল বাবদ দেড়শো টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসল, বাবা সাজঘরে ট্রাঙ্কের ওপর বসে কাঁদতে লাগলেন– এককোণে, অন্ধকারে।
পরদিন চম্পা এসে দাঁড়াল বোর্ডের সামনে–মিস চম্পা–প্রাচ্যের সেরা রূপসী–যার অঙ্গুলি হেলনে আকাশের বিদ্যুত স্তম্ভিত হয়। পরনে গলা থেকে পা পর্যন্ত সিল্কের আটো পোশাক। কোমর, নিতম্ব আর হাঁটুর প্রতিটি ভাঁজে যেন দাঁত কামড়ে বসেছে কাপড়, ওপরে লাল সিল্কের তেমনি আঁটোসাটো খাটো কোর্তা, চক্রাকারে কাপড় সেলাই করে দুটো বুক চাঁদের মতো স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে, মাথার চুল সাবান ঘষে ফোলানোপায়ে নীল সিল্কের জুতো। বাজনা বাজল, চম্পা এসে দাঁড়িয়েছে, জহির ছোরা তুলে তাক করল। বিদ্যুত নেচে উঠল চম্পার চোখে একপলকের জন্যে। জহিরকে কিন্তু সে কথা ভাববার সময় নেই। দুম্। চোখ না নাবিয়েও চম্পা বুঝতে পারল একটা ছোরা এসে ঠিক তার গালের পাশে গাঁথল। একটা নিঃশ্বাস পড়ল চম্পার সারা হল এতো নিস্তব্ধ যে, সেটাই তার নিজের কানে শোনাল ঝড়ের মতো। দুম দুম দুম্। আর নিঃশ্বাস পড়ল না। সাতাশ–আঠাশ উনত্রিশ–ত্রিশ। সারা হল ফেটে পড়ল উল্লাসিত হাততালিতে। বোর্ড থেকে সরে এসে তিনবার মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করল চম্পা। জহির তার কোমর জড়িয়ে ধরে মাথা নুইয়ে আবার লম্বা এক সালাম করল। আবার হাততালি। আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তখন চম্পার মনে হলো জহির ফিসফিস করে বলছে, মন বলছিল, তোকে জখম করে দিই চম্পা। তার ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কিছু বলতে পারল না সে। জহির বলল, কিরে ভয় পেলি নাকি! ঠাট্টা করছিলাম।
কিন্তু চম্পার এতো করাও শুধু শুধু। বাবার কাঁদতে হলে কারণ লাগে না। একেক সময় তার মনে হয়, বাবার মতো শিশু দ্বিতীয়টি আর নেই। আবার এক সময়ে মনে হয়, ঐ কান্না তার সমস্ত দুর্ভাগ্যের প্রতীক। মনে হয়, দল থেকে পালিয়ে যাই। ওপরের গ্যালারীতে বউ ঝিয়েরা বাচ্চা–কাচ্চা নিয়ে এসে বসে ঘোমটা তুলে এ ওর হাত ধরে মাথা কাৎ করে তন্ময় হয়ে দেখে, কোলের ছেলেটা কাঁদলে তার মুখে মাই তুলে দিতে দিতে দেখে একের পর এর তাস উড়ে যাচ্ছে হাত থেকে, কংকাল নাচতে নাচতে এসে জড়িয়ে ধরছে চম্পাকে, চুমো খেতে চাইছে আবার ভ্রূকুটি করতেই দূরে সরে যাচ্ছে। চম্পা ভাবে, সেও যদি এ রকম ম্যাজিক দেখতে পারতো বিরাট বিস্ময় নিয়ে, কোলে থাকতে খোকা, পাশে বসে ননদ কাঁধ জড়িয়ে ধরত ভয়ে।
ছোবার সেই প্রথম শো–এর পর থেকে, আজ বছর দুই হবে, চম্পা একটু বিরক্তই হয় বাবাকে কাঁদতে দেখলে! এ এক অদ্ভুত কান্না। এক ফোঁটা পানি পড়ে না, একটু শব্দ হয় না। কাল রাত্তিরেও। কাল জহিরের দোষে আস্তিনের লুকোনো পকেট ছিঁড়ে গিয়ে খেলা প্রায় ফাঁস হয়ে যাবার যোগাড়, জোর সামলে নিলেন বাবা; কিন্তু শো শেষে কিসসু বললেন না জহিরকে, খেতে বসে ঠিক ঐ রকম শব্দহীন কান্না। বাবা যেন ভয় করেন, জহির চলে গেলে দল ভেঙে যাবে তার বাবা মায়াশক্তিসম্পন্ন প্রফেসর নাজিম পাশা।
.
বৃষ্টিটা একটুও কমেনি। বরং বুঝি আরে; জোব হয়েছে। প্রফেসর দুহাতে মুখ ঢেকে বসে। আছেন। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে শিশিরের মতো সাজ হয়ে পড়েছে তার দুহাতের পিঠে। চম্পার পায়ের শব্দে পায়রাগুলো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। চম্পা একটু বিরক্তি নিয়েই ডাকাল, কী বাবা?