জহির এগিয়ে এলো না। স্টেজের প্রায় পেছন পর্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে কী বলল শুনতে পেল কেউ এক বর্ণ। চেঁচিয়ে উঠল সবাই–লাউডার প্লিজ, লাউডার প্লিজ। সেই সঙ্গে একটা তীক্ষ শিষও শোনা গেল।
দুপা এগিয়ে এলো জহির। ভদ্র মহিলা ও দ্ৰ মহোদয়গণ, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, আপনাদের প্রিয় আর্টিস্ট মিস চম্পা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আজ শো দেখানো সম্ভব হবে না। দ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ দড়াম করে এক পাটি জুতো এসে পড়ল স্টেজের ওপর। যেন কিছুই হয়নি, জহির আবার শুরু করল, গলা চড়িয়ে, ভদ্র মহিলা–এবার সাইকেলের আধাখানা টায়ার আর ইটের আস্ত একথান এসে পড়ল স্টেজে। এ এক অদ্ভুত জনতা। এরা কথা বলে না। এরা হাতের কাছে যা পায় ছেড়ে, শিষ দেয়, বাচ্চারা কাঁদে। এরি মধ্যে মেয়েদের অভিভাবকেরা মেয়ে সামলাবার জন্যে চারদিকে ওঠবোস করতে শুরু করেছেন, কেউ কেউ বেরিয়ে আসছেন।
গোলাপের গন্ধ পেল চম্পা। চঞ্চল হয়ে অন্ধকার ঘরে সে উঠে বসল। কোথায় সে? ঠিক সেই সুগদ্ধ। সারা ঘর ম ম করছে। উঠে দাঁড়াল চম্পা। সারা দিনের অনাহার পাক দিয়ে উঠল পেটের ভেতরে। মাথাটা বালিশে বেখে শুয়ে পড়তে হল। তখন আর কোন বোধশক্তিও রইল না। শুধু মনে হল, মাথার মধ্যে রামধনুর মতো একটা রঙিন জাঁতা ঘুরছে।
স্টেজে দাঁড়িয়ে জহির আরেকবার চিৎকার করে বোঝাতে যাবে, এমন সময় দেখল, পাশে ফিরদৌসি এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে তার শো–এর পোশাক, চুল আঁচড়ানো, জ্বলজ্বল করছে মুখ। আচমকা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল জহিরের। খপ্ করে ফিরদৌসির হাত ধরে সে দ্রুত স্খলিত কণ্ঠে বলল, গোলাপের খেলাটা শুরু করে। এরা মানছে না!
হলের ভেতরে আরো কয়েকখানা ইট এসে গিয়েছিল, যারা এনেছিল নিঃশব্দে পায়ের কাছে লুকিয়ে ফেলল। কয়েকজন আঙুল তুলে বলাবলি করতে লাগল ফিসফিস করে, ঐ যে, ঐ লোকটা ঐ যে পরে এলো, বাম দিকে। একটা বাচ্চা তখনও কাঁদছিল, সেও থেমে গেল, মা–র দুধ আবার মিঠে মনে হল তার।
তাকে কোন কথা বলতে না দেখে জহির চাপা গলায় হিস হিস করে উঠল– ফিরদৌসি! যাও, সামনে যাও! হ্যাঁ করে থেকো না। বলতে বলতে সে ঠেলে দিল তাকে সামনে।
লোকেরা তখন নড়ে বসল। কেউ কেউ হাততালি দিয়ে উঠল। বলল, আমাদের গোলাপ দেবে।
এক মুহূর্তে ফিরদৌসির মনে পড়ল সব। কুড়িগ্রামে সেই বৃষ্টির সন্ধ্যে, চম্পার সঙ্গে রাত, প্রফেসরের তিরস্কার। বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে সে দেখতে পেল নিজেকে। তাকে বেছে নিতে হবে। এখন। এই মুহূর্তে। হলের অন্ধকার ছাদে সে দেখতে পেল রক্তগোলাপের চিত্র। সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল তার। কেউ বিশ্বাস করবে না, চম্পা। চম্পা, পালাতে নেই। ছিঃ।
আজকের সাতশ ছিয়াশিটা গোলাপ সে নিঃশেষ করে ফেলেছে। তবু সে আবার একাগ্র করে আনল তার সমস্ত বিক্ষিপ্ত মন। বিড়বিড় করে বলল, আছে, আছে, আসবে, আমি আনতে পারবো, আজ আরেকবার আমাকে দাও। দর্শকদের দিকে তাকাল সে পূর্ণ দুচোখ মেলে। অপলক তাকিয়ে আছে তারা। প্রত্যাশায় তাদের চোখ কোমল হয়ে উঠেছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন শোনা যাচ্ছে হৃৎস্পন্দন–আমি সবাইকে দেবো। কেউ শূন্য হাতে ফিরে যাবে না। কেউ বিশ্বাস না করুক, আমার কি তাতে এসে যাবে? ওদের হাতে, প্রত্যেকের বাড়ি নিয়ে যাওয়া গোলাপের সাথে, আমি প্রত্যেকের বাড়ি যাই। দর্শকের ওপর থেকে তার চোখ ফিরিয়ে আনল সে। জহিরকে বলল, শো বন্ধ থাকবে না। রোজ যেমন যে আইটেম দিয়ে শুরু হয়, তেমনি হবে।
শান্ত স্তব্ধ প্রতীক্ষায় অধীর দর্শকের সামনে এগিয়ে এলো ফিরদৌসি। মেঘের মতো সুদূর গম্ভীর কণ্ঠে সে ঘোষণা করল, আমার ভাই–বোনেরা, হতাশ হবেন না। বহুদূর থেকে এসেছেন আপনারা আশা নিয়ে, শো হবে।
করতালিতে ধ্বনিত হয়ে উঠল হল।
অন্ধকার ঘরে স্বপ্নের মধ্যে প্রফেসর যেন শুনতে পাচ্ছেন দর্শকের করতালি, প্রতীক্ষা, আবার করতালি, ব্যাণ্ডের আওয়াজ। অবাক হয়ে গেলেন তিনি। শো হচ্ছে। ঐতো ওরা আনন্দে আবার করতালি দিয়ে উঠল। ঐ, ঐতো। উঠে দাঁড়িয়ে চম্পার কামরায় এলেন। অবাক হলেন দরোজা বন্ধ দেখে। তা হলে চম্পা স্টেজে যায়নি। কিন্তু এইমাত্র তিনি যে শুনতে পেলেন সেই বাজনা, যে বাজনা বাজে চম্পা যখন বোর্ডে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় আর তিরিশটা ছোরা হাতে জহির একের পর এক ছুঁড়তে থাকে। ঐতো সে বাজনা শুরু হল। চম্পা, চম্পা। পাগলের মতো প্রফেসর স্টেজের দিকে ছুটলেন। কিন্তু প্রত্যেকটা দরোজায় এতো ভিড় ঢুকতে পারলেন না। সবাই বিরক্ত হয়ে তাঁকে কনুই দিয়ে ঠেকিয়ে রাখল। কেউ ফিরেও তাকাল না তার দিকে। কেউ চিনতে পারল না। তখন পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করলেন। সে দরোজাও বন্ধ। দমাদম আঘাত করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু শোনা গেল না। প্রবল বাজনার অতলে তলিয়ে গেল প্রফেসর নাজিম পাশার করাঘাত। আজ তিনি বাইরে। তাকে বাইরে থাকতে হচ্ছে। আজ আর ঢুকতে পারবেন না তিনি। কোন দরোজা খোলা নেই তার জন্যে।
বোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে ফিরদৌসি হাসল। হাসল না তো যেন একখণ্ড স্মিত বিদ্যুত স্থির হয়ে রইল তার ঠোঁটে। আধখানা বৃত্ত আঁকল ডান হাত দিয়ে জহির তার পেছনে, তারপর বৃত্তটাকে চোখের পলকে প্রসারিত করে দিল সমুখে, সরল রেখায়।