আবার অভিমানটা সচল হয়ে উঠল বুকের ভিতরে। গুমরে মরতে লাগল প্রফেসরের তিরস্মারগুলো। অবোধের মতো কয়েকবার মাথা নাড়ল ফিরদৌসি। হাতের গোলাপটা দেখল। আনমনে একটা পাপড়ি ছিঁড়ল তার। তারপর আরেকটা। এমনি করে সব কটা। ছিড়ি উড়িয়ে দিল বাতাসে। তারা পায়ের কাছে নিঃশব্দে এসে পড়তে লাগল। যখন শেষ হয়ে গেল আরেকটা গোলাপ বার করল সে ভিতের ফাটল থেকে। তারও সব পাপড়ি বসে বসে ছিঁড়ল সে। আরেকটা বার করল। তখন যেন নেশায় পেয়ে বসল তাকে। একে একে সাতশ ছিয়াশিটা গোলাপ কখন সে বার করল এখানে ওখানে স্পর্শ করে আর তাদের পাপড়ি ছিঁড়ল। পায়ের কাছে পাহাড় হয়ে উঠল রক্তগোলাপের ছেঁড়া পাপড়িতে। আবার যখন হাত রাখল তখন আর গোলাপ পেল না। তখন মনে পড়ল, সাতশ ছিয়াশিটা হয়ে গেছে, আজ আর আসবে না। তখন মনে পড়ল, কেউ বিশ্বাস না করুক, কেউ তাকে ভাল না বাসুক, একজন তাকে বিশ্বাস করে, একজন তাকে অবহেলা করেনি। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল চম্পার কপালে দুলতে থাকা চাঁদের মতো একগুচ্ছ চুল। তখন সে উঠে দাঁড়াল। চারদিকে সূর্যশেষের অন্ধকার। হাঁটতে লাগল ফিরদৌসি। সে ফিরে আসতে লাগল স্কুলের দিকে।
কাউকে জিগ্যেস না করে বেওকুফের মত। টিকেট ঘরের জানালা খুলে বসেছে পটকা আর চালকুমড়ো। চেহারা ভব্য করে টিকেট বেচতে শুরু করেছে। বিক্রিও হচ্ছে রমারম। দিয়ে কুলান নেই। অথচ ওদিকে সাজঘর অন্ধকার। দরোগা দিয়ে নোক ঢুকছে। এখানকার যারা বায়না করে এনেছিল তাদের লোক গেটে গেটে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে পথ দেখাচ্ছে। কেউ বলছে, দেখবেন মা বোনেরা, ওখানে একটা গর্ত আছে। এই ভাগো, ভাগো হিয়াসে। দরোজায় খিল দিয়েছে চম্পা। আর খুলছে না। জহির আর সামাদ ডেকে ডেকে সারা হল, সাড়া পেল না। গলা তুলতে পারল না, দরোজা ভাঙতে পারল না, পাছে লোক জানাজানি হয়ে যায়।
আর প্রফেসর সেই দুপুর থেকে শুয়ে কাঁদছেন, কাউকে চোখেও দেখছেন না। কথা বলবার শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। চম্পা তার মুখের ওপর বলেছে, না, এ বিয়ে আমি চাই না।
চম্পা।
না, না, না।
সেই মুহূর্তে যেন প্রফেসর চম্পাকে নতুন করে দেখেছিলেন। মিস চম্পা–প্রাচ্যের সেরা রূপসী–যার অঙুলি হেলনে আকাশের বিদ্যুৎ স্তম্ভিত হয়–সে নয়; তাঁর মেয়ে চম্পা। তখন বড় ক্লান্ত মনে হল নিজেকে। এক পাক গ্লানিতে ডুবে গেলেন তিনি। অপরাধীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চম্পা চলে গেল পাশের ঘরে, দৃপ্ত পা ফেলে। গালে তার পাঁচটা আঙুলের ছাপ নীল হয়ে ফুটে রয়েছে তখনো।
ফিরদৌসি! বিদ্যুতের মতো তার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রফেসর নাজিম পাশার প্রফেসর জে.সি. দত্ত–র সাকরেদ মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন ভূইয়া যিনি বারো বছর আগে নিজে এই দল করেছিলেন, তাঁর। চমকে উঠলেন তিনি। যেন সরে গেল স্টেজের উপর থেকে কালো পর্দা। দেখতে পেলেন নিজেকে, জহিরকে, চম্পাকে। ফিরদৌসি আসবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যা ছিল গোপন, সে এলো আর তা বেরিয়ে পড়ল– এক অপরিসীম ক্ষুধা, গ্লানি আর করুণার চিত্র, অন্ধকারে নৃত্যপর কংকাল আর উড়ন্ত রৌপ্যমুদ্রা। সে এক নির্মম আগন্তুক, ফিরদৌসি। হাতে তার রক্তগোলাপ।
বালিশে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন প্রফেসর। যোগ্য মনে হল না নিজেকে যে চম্পাকে ডাকবেন, সাহস হল না জহিরকে সামনা করবেন, ভয় হল খুঁজতে গিয়ে ফিরদৌসিকে যদি আর না পাওয়া যায়।
প্রফেসরকে ডাকতে যাচ্ছিল জহির, এমন সময় যারা বায়না করে এনেছিল তাদের একজন পাকড়াও করল তাকে। কী আপনাদের দেরি কিসের? সাতটা কখন বাজে। পাবলিক আর বসে থাকতে চাইছে না।
জহির কোন রকমে উত্তর দিল, এই এক মিনিট। লোকটা চলে গেলে দৌড়ে। সে প্রফেসরকে ধাক্কা দিয়ে জাগাল– ওস্তাদ, শো–র টাইম হয়ে গেছে। চম্পা দরোজা খুলছে
। টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। ওস্তাদ। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল জহির। প্রফেসর অস্পষ্টভাবে একটা হাত নাড়লেন। জহির আবার তাকে ধাক্কা দিল, ডাকল, ওস্তাদ। পাবলিক বসে আছে। আধঘণ্টা হয়ে গেছে। প্রফেসরের হাতখানা অসাড় হয়ে পড়ে গেল বিছানায়।
ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি শো–র শুরুতে বাজাবার জন্যে একটা গৎ জানতো মিনিট পনেরোর। সেটা দুবার বাজাল। তবু যখন পর্দা উঠল না তখন ঘাম ছুটল তাদের সারা শরীরে। পর্দার এক পাশে দর্শকদের দিকে আড় হয়ে তারা বসেছিল। তাদের ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে দেখে তারা ঘনঘন তাকাতে লাগল পর্দার দিকে আর ঢোক গিলল। গৎটা যখন দুবার বাজানো হয়ে গেল, থামল, তখন এক মুহূর্তের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল হল। সবাই ভাবল বাজনার এই বিরতি বোধহয় পর্দা ওঠার ইঙ্গিত। কিন্তু তা যখন হল না, তখন দ্বিগুণ অস্থির হয়ে উঠল তারস্বরে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ব্যাপাটির চারমূর্তি কংকাল–নৃত্যের সঙ্গে বাজাবার গণ্টা শুরু করে দিল চড়া পর্দায়।
তখন হঠাৎ পর্দা উঠল। লোকেরা অন্ধকারের মধ্যে প্রথমে কিছু ঠাহর করতে পারল না। ব্যাপাটির চারমূর্তি অবাক হয়ে গেল শো–এর শুরুতে প্রফেসরের বদলে জহিরকে দেখে। তার মুখে পায়রার আঁচলের দাগগুলো পাউডারেও ঢাকে নি। এক অজানা ভয়ে ভেতরটা হিম হয়ে গলে চারমূর্তির, কিছু বুঝতে না পেরে আচমকা বাজনা থামিয়ে দিল তারা।