আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে গেল ঘর। কেবল প্রফেসর আর ফিরদৌসি মুখোমুখি।
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত অতিবাহিত হয়ে গেল। যেন এ নিস্তব্ধতা আর কোনদিন ভাঙবে না। হঠাৎ ফেটে পড়লেন প্রফেসর নাজিম পাশা বেরিয়ে, বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে। চঞ্চল হয়ে উঠল ফিরদৌসি।
আমি ঢের সহ্য করেছি। কাল রাত্তিরে আমার কথার জবাব না দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলে। এখন বুঝতে পারছি, সাহসটা কোথায়। করো তো বাপু মেসমেরিজম। তাই বলে আমার মেয়ের ওপরেও? তবে জেনে রাখো, মেসমেরিজম আমিও জানি। আমিও পারি তোমাকে এক পায়ের ওপর সারা জীবন দাঁড় করিয়ে রাখতে, বোবা বানিয়ে রাখতে পারি, কুঁজো বানিয়ে রাখতে পারি, রাস্তার কুকুর করে রাখতে পারি। আমার মেয়েকে নিয়ে পালানোর মতলব? আমার খেয়ে আমারই শত্রুতা? ইতর, বদমাশ, বেরিয়ে যাও।
একটা কথার জবাব দিল না, প্রতিবাদ করল না ফিরদৌসি। প্রফেসরকে সে ভক্তি করতো, প্রথম দিন থেকে সবাই তাকে দূরের আর অহলার মনে করেছে, একমাত্র প্রফেসর করেননি–তখনই যেন সে কেনা হয়ে গিয়েছিল তার। সে কথা আজো ভোলেনি ফিরদৌসি! চোখ ফেটে পানি আসতে চাইল। মনে হল, তার বাবা মরে গেলেন এই মাত্র। সবচে বড় হয়ে বাজল, মেসমেরিজমের অভিযোগ। জহির বলেছে, কিছু মনে হয়নি। প্রফেসর বললেন, আত্মধিকারে ভরে উঠল তার মন। মাথা নিচু করে সে বেরিয়ে গেল।
ফিরে এসে প্রফেসর যখন দেখলেন চম্পা ওষুধ বার করে দেয়নি, আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে, অন্ধের মতো চড় বসিয়ে দিলেন গালে। চম্পা সে আঘাত সইতে না পেরে একটা হাতল ভাঙা চেয়ারের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। এতোটা হবে ভাবেননি তিনি। কিন্তু হঠাৎ বিচলিত হতেও বাধল তার। তাই আরো গলা চড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি তুমি ভেবেছ কী? আমার চোখের ওপর, এতো সাহস তোমার? তোকে আমি সাত টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো, আজই বিয়ে দেবো তোর। এতো বড় সাহস, আমি মরে গেছি মনে করেছিস?
পিটপিট করে চোখ খুলল জহির। ফিটকিরি দিয়ে মুখ ঘষে দিয়েছিল চালকুমড়ো, কনকন করছে, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ, তবু তাকাল জহির। একটু জোরে কঁকিয়ে উঠে জানান দিতে চাইল নিজেকে।
বোধহয় তাতে কাজ হল। প্রফেসর নতুন করে বলে উঠলেন, পালাবার মতলব দিচ্ছে, সে তোরই কপাল ভাঙবার জন্যে।
বাইরে জহির আবার কঁকিয়ে উঠল– চাই না, চাই না আমি কিছু। আমি একমুহূর্ত আর থাকবো না। সব খেলা আমি ফাঁস করে দেবো। দেখি কে আমাকে ঠেকায়! দেখি, কোন শালা শো দ্যাখে। আমি মানুষ না, না? চম্পা আমাকে অপমান করল সেদিন কিছু বললাম না। আর সহ্য করবো না। বেরিয়ে যাবো। সব ফাঁস করে দেবো। আমি কারো খাই না পরি?
মহা ফাঁপরে পড়লেন প্রফেসর। জহির দল ছেড়ে চলে গেলে যে একেবারে পথে বসতে হবে তাঁকে। আর তার ওপর যদি একেকটা খেলা সবার কাছে ফাঁস করতে থাকে তো আর ভাবতে পারলেন না তিনি। চম্পাকে ধমকে উঠলেন, জহিরকে হাতে করে শেখালাম পড়ালাম সে কার জন্যে রে? আমার কী? দেখি, আমি মরে গেলে কী খাস? দেখি, তোর বাড় কদ্দূর।
তারপর ধপ করে চৌকির ওপর বসে পড়লেন তিনি। চম্পা ভাবল, বোধহয় নিঃশব্দ আবার কাঁদছেন বাবা। চোখের কোণ দিয়ে দেখল– না, অপলক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, প্রফেসর বললেন, তোর বিয়ে দেবো জহিরের সাথে। কোন কথা শুনতে চাই না আমি।
খাঁড়ানাক সে সময়ে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, ওষুধটা।
ও হ্যাঁ, ওষুধটা। বলে প্রফেসর তার হাত–বাক্স থেকে মলমের কৌটোটা বার করে দিলেন।
.
ফিরদৌসি যেতে পারল না কোথাও, যদিও যেতে ইচ্ছে করল তার। কাঁদতে পারল না, যদিও কাঁদতে ইচ্ছে করল। স্কুলের পেছনে, পাঁচিলের ওধারে এককালে দালান ছিল, এখন শুধু ভিতটা আছে সেখানে গিয়ে সে বসল। সারাদিন বসে রইল সেখানে। প্রফেসর তাকে মেসমেরিজমের কথা বলে যে কষ্ট দিয়েছেন, তার কোন পরিমাপ নেই। তবু আঙুল দিয়ে ধূলোর ওপর দীর্ঘ দাগ দিল, ছোট করল, একেবারে মুছে ফেলল, আবার নতুন করে আঁকল সে। আবার, আবারও। সারাদিন। ব্যাপার্টির চারমূর্তি কুলি ছেলেদের ঘাড়ে পোস্টার তুলে হ্যাঁবিলের তাড়া নিয়ে বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল নিত্যকার মতো শহর পরিক্রমায়। সে বাজনা কানেও গেল না ফিরদৌসির। কেউ তাকে খুঁজতে এলো না। সারাদিনের ক্ষুধা তৃষা কেউ কাছে এলো না। শুধু কেঁপে উঠল ঠোঁট। নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলতে লাগল ফিরদৌসি। আমি কী করেছি?
আমার আমি চম্পা, কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি কী করেছি? একটা বেড়াল অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছিল তার সামনে, সবুজ চোখে তাকাচ্ছিল আর চোখ বুজছিল। সাহস করে যখন একেবারে কাছে এসে গলা তুলে ডাকল মিহি করে, তখন তাকে কোলে তুলে নিল সে। পেটে পিঠে হাত বুলাতে বুলোতে বলল, কিরে হতভাগা?
এতো নাচ দেখাচ্ছিলি কেন? পিঠ উঁচু করে পায়ে পায়ে ঘোরাই তোর সার হল। আমার কাছে কিছু নেইরে, কিছু দিতে পারবো না। তখন বিড়ালটা গরগর করে উঠল। ফিরদৌসি বলল, বললাম, আমার কিছু নেই। আচ্ছা এটা নিবি? বেড়ালটা তার হাতে অতবড় লাল গোলাপটা দেখে ভড়কে গেল, চোখ বুজল এক মুহূর্তের জন্যে, তারপর লাফ দিয়ে তীরের মতো পালিয়ে গেল। আর এলো না। হা হা করে হেসে উঠল ফিরদৌসি। হাসতে হাসতে দম বন্ধ হতে বসল, শরীরটা সামনে ঝুঁকে পড়ল, তবু সে হাসি থামল না। তার দমকে চোখ ভরে গেল পানিতে, ঝর ঝর করে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। তারপর হাসিটা বন্ধ হয়ে গেল, শুধু পড়তে লাগল পানি।