জহির বলল, আমি নিজে দেখেছি ওস্তাদ। পটকা, বোচানাক ওরাও দেখেছে। বাঞ্চোতের সাধুপনা আজ আমি গলায় পা দিয়ে বর করবো। কুত্তা কাঁহি কা।
প্রথমে দেখেছিল বোচানাক। ভোরবেলায় উঠে টিউবওয়েলের দিকে যাচ্ছিল, দেখে দরোজা হাট করা। ভেতরে ফিরদৌসির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে চম্পা।
প্রফেসরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল জহির। চিৎকার করে বেলা মাথায় তুলে ফেলল– আমি আর একদণ্ড নেই দলের সঙ্গে। এ সব ত ম দেখতে পারবো না। গোলাপের গুণ এতো করে জিগ্যেস করল তবু বলল না। কতো বড় ওস্তাদ? এখন আবার ছি ছি কেলেঙ্কারী! এই আমি চললাম। দেখি, কে আমাকে রাখে। ওস্তাদ তো বুড়ো হয়ে চোখের মাথা খেয়েছে। আমি না থাকলে কবে ছত্রখান হয়ে যেতো।
তাকে আর কিছুতেই থামানো গেল না।
প্রফেসর প্রথমে বিহ্বল, পরে ভীত, শেষে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। গতরাত্রে ফিরদৌসির ব্যবহারে এমনিতেই মর্মাহত হয়েছিলেন, আজ এ কথা শুনে আগুন জ্বলে উঠল শরীরে। তার ওপরে বারান্দা থেকে জহিরের ক্রমাগত দল ছেড়ে যাওয়ার হুমকি শুনে পায়ের নিচে এক ফোঁটা মাটি পেলেন না তিনি।
ওদিকে এতো চিল্কারের উৎপত্তি, দুজন জেগে গেছে। তারা দুজন দুজনের দিকে তাকাল, সে দৃষ্টিতে বিনিময় হল আমরণ বিশ্বাসের এক ক্ষণবিদ্যুৎ।
চম্পা বেরিয়ে এসে বারান্দা ঘুরে, ঘরের মধ্যে প্রফেসর আর বাইরে জহির ও ব্যাপার্টির চারমূর্তির সমুখ দিয়ে মাথা উঁচু করে, স্মিত মুখে চলে গেল যে ঘরে উনুন করা হয়েছিল।
সেখানে সে ছাই তুলে দাঁত মাজতে লাগল টুলের ওপর নির্বিকার বসে বসে পা দুলিয়ে। পটকা এলো, তার পায়ে পা দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, কচ্ছপের মতো আর হাঁটতে হবে না। চা কর শীগগীর, খিদেয় মাথা ঘুরছে। পটকা যেন সে কথা শোনেইনি, চোয়াল ঝুলিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তখন চম্পা তার কান ধরে উনুনের কাছে দাঁড় করিয়ে দিল। হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, কান তো নয়, দুটো আমের আঁটি। কী শক্তরে বাবা!
ফিরদৌসি এসে দেখল পায়রার খোপে পায়রাগুলো ডানা ঝটপট করছে আর তারের জালে ঠোঁট ঘষছে, যেন কেটে ফেলবে। সে চোখ গোল করে বলল, দাঁড়া, দাঁড়া। তারপর একটা একটা করে তাদের বার করতে লাগল আর আঙুল দিয়ে পালকে চিরুনি করতে করতে আদর করল, নকল স্বরে বাক্–বাকুম ডাকল, গালে গলায় চেপে ধরতে লাগল চোখ বন্ধ করে, ঘষতে লাগল।
সে রাতে চম্পাকে জোর করে অঙ্কশায়িনী করবার পর থেকে মনের মধ্যে একটা গ্লানি ছিল জহিরের যেটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। চেঁচামেচি করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল গ্লানিটা যেন আর নেই। তখন আরো চিৎকার করতে লাগল সে, জেদি একটা খোকার মতো এক কথাকেই বারবার বলতে লাগল, শেষে তেড়ে গেল ফিরদৌসিকে আজ একচোট শিক্ষা দেবে বলে। আজ একটা সুযোগ, আজকের আগুনেই তাকে জঞ্জাল পুড়িয়ে পথ পরিষ্কার করতে হবে। রোষটা নিভে যেতে দিলে চলবে না।
ওরে বদমাশ, পায়রা আদর করা হচ্ছে। ফিরদৌসিকে দেখতে পেয়েই তিড়বিড় করে উঠল জহির। তার পেছনে এসেছেন প্রফেসর, নিঃশব্দে। জহির বলল, কথার জবাব নেই কেন?
ফিরদৌসি বড় বড় চোখ মেলে তাকাল। বলল, আমাকে কিছু বলছিলে? বলেই সে আবার পায়রার দিকে মনোযোগ দিল।
চিৎকার করে উঠল জহির, তোমার আস্পর্দা আমি দেখছি। আমার বউয়ের ওপর মেসমেরিজম? তার জাত নষ্ট করা?
তোমার বউ? অবাক হল ফিরদৌসি।
হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল জহির। তারপরই স্বমূর্তিতে ফিরে গেল সে। ঐ একই কথা। বউ না হোক, চম্পার সাথে আমার বিয়ে হবে।
আমি তো চম্পাকে বললাম, পালাতে নেই। তোমাকে বলেনি?
এবার জহিরের অবাক হবার পালা। প্রফেসরও বিস্ময়ে বলে উঠলেন, কে পালাতে চায়?
তেমনি শান্তকণ্ঠে পায়রা আদর করতে করতে ফিরদৌসি জবাব দিল, কেন, চম্পা। বোকা মেয়ে, ওকে বললাম…
জহির প্রফেসরকে বলল, ওস্তাদ, চম্পাকে নিয়ে পালাবার মতলব আঁটছে। এখন ধরা পড়ে মিউ মিউ করছে মেনি বেড়ালের মতো। বটে, পালাতে হলে জানটা রেখে পালাবি হারামজাদা।
বলেই এক ঝটকায় ফিরদৌসিকে টেনে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল জহির। এই আকস্মিকতায় হঠাৎ ফিরদৌসির হাত থেকে পায়রাটা ছাড়া পেয়ে গেল, বিষম ভয় পেয়ে সেটা এক প্রবল শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল জহিরের মুখে মুখটাকে একটা কার্নিশ কী গাছের ডাল মনে করে সেখানে বসবার জন্যে দুপায়ের তীক্ষ্ণ নখর মেলে আঁচড়াতে লাগল। মুহূর্তে সূতোর মতো অসংখ্য রক্তাক্ত রেখা ফুটে উঠল জহিরের মুখে। বিকট আর্তনাদ করে উঠল সে। দুহাতে মুখ ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। আর বোকার মতো দাঁড়িয়ে প্রফেসর আরে এ–কী করতে লাগলেন। তখন ফিরদৌসি খপ করে পায়রাটাকে ধরে হাতের এক লম্বা দুলুনি দিয়ে উড়িয়ে দিল জানালা দিয়ে।
তার চিৎকারে ছুটে এলো সবাই। ব্যাপার্টির চারমূর্তি রক্ত দেখে খুন খুন বলে লাফাতে লাগল। সামাদ এসে চেপে ধরল জহিরের হাত। জহির হাঁপাচ্ছিল, তখনো মুখ ঢাকছিল, যদিও পায়রাটা ছিল না। প্রফেসর তাকে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, চুপ চুপ। তার সবচে বড় ভয়, বাইরের কেউ শুনতে পেলে দলের সুনাম নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। সবার শেষে এসে দাঁড়াল চম্পা।
চম্পা যেন তার বাবাকে আজ আর চিনতে পারল না। রুষ্ট স্বরে, সম্রাটের মতো তাঁর কণ্ঠে আদেশ, এই ওকে ঘরে নিয়ে ওষুধ দাওগো। চম্পা, তুমি যাও, আমার হাত–বাসে ওষুধ আছে। সামাদ, বাইরে দাঁড়িয়ে দ্যাখো, বাজে লোক ভিড় করতে দিও না।