চম্পা তখন ম্লান হেসে উত্তর দিল, নারে কিছু না। তুই ঘুমোগে। বড্ড গরম পড়েছে।
চলে গেল পটকা। তখন আরো একা লাগল চম্পার। আস্তে আস্তে প্রাণহীনের মতো বসে পড়ল সে টুলের ওপর। শেষ হ্যাঁজাকটা জ্বলছিল শেষ প্রান্তে জহিরদের কামরায় শো হচ্ছিল হাইস্কুলে আমের বন্ধে–নিভে গেল! যেন লাফিয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ চারদিকের ওৎ পেতে থাকা অন্ধকার। স্কুলের সামনে বিরাট জামরুল গাছের পাতা সরসর করতে লাগল। দূরে একটা লিচু গাছে ঢন্ ঢন্ করে বাজতে লাগল বাদুর–তাড়ুয়া টিন। একটা কুকুর রাস্তার ওপর বেরিয়ে এসে চারদিকে দেখল, মাটি শুকল তারপর জ্বলজ্বল কোটি কোটি তারার দিকে মুখ তুলে অবিকল মানুষের বাচ্চার মতো কেঁদে উঠল।
.
ঘুমের মধ্যে জেগে উঠল চম্পা। বালিশ থেকে মাথা তুলে দেখে বাবা তার চৌকিতে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। নিচে মাটিতে রাখা হারিকেন জ্বলছে চোখ বুজে। আর কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু তবু কে যেন তাকে ডাকছে, শোনা যাচ্ছে না, বুকের ভেতরে ঠেলে ঠেলে উঠছে নিঃশ্বাস।
স্কুলের প্রায় সবগুলো দরোজাই ভোলা। অন্ধকারে তারা হাঁ করে আছে এক অমিত ক্ষুধা নিয়ে। তাদের প্রত্যেকের সামনে বাতি নিয়ে দাঁড়াল চম্পা। এ ঘর সে ঘর খুঁজল, কিন্তু পেল না। লম্বা বারান্দায় কাঠের থামগুলো একের পর এক পেরিয়ে এসে নিরাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। আবার কেঁদে উঠল সেই কুকুরটা। আবার ঠেলে ঠেলে নিঃশ্বাস। আবার খুঁজল চম্পা। তখন পেল। একেবারে মুখের পরে মুখ রেখে ফিসফিস করে ডাকল– ফিরদৌসি।
সে শুয়েছিল একা একটা ঘরে, শানের ওপর, বুক অবধি পা দুটো টেনে, জড়সড় হয়ে। মাথা থেকে সরে গেছে বালিশটা।
সেই রাস্তায় ঘুমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল ফিরদৌসি, হঠাৎ বিহ্বলের মতো চলতে শুরু করল। মাঝপথে এসে থামল, বুঝতে পারল না। কোন দিকে যাবে। ফিরে যাচ্ছিল, আবার থামল। তারপর এ মাথায় এসে দেখতে পেল চম্পাকে, চম্পার নতমুখে একগুচ্ছ চুল। বলল, চম্পা, আমি যাবো না, আমি যাব না।
তার কপালে হাত রাখল চম্পা। ফিরদৌসি সে হাত ধরে উঠে বসল তখন। বলল, কেন ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে?
কী?
আমি যে কিছু বলতে পারি না। আমি যেতে চাই না, চম্পা। বলতে বলতে সে হাত রাখল চম্পার চুলে, সেখান থেকে বেরুল গোলাপ। স্বপ্নের মতো হাসল চম্পা। এক হাতে সেটাকে সে ধরে রইল দুজনের মাঝখানে। চম্পা বলল, চলো, আমরা যাই। যাবে?
কোথায়?
চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। নাগরদোলার মতো তাদের চোখ থেকে চোখে উঠতে পড়তে লাগল আনন্দ, বিষাদ, বাস্তব, বিভ্রম।
ফিরদৌসি তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে চুলের মধ্যে ঠোঁট রেখে বলতে লাগল, প্রথম যেদিন এলাম, তোমার কপালে এসে পড়েছিল চাঁদের মতো কয়েকটা চুল। তোমার মনে নেই চম্পা? আমার তখন মনে হল, আমি পারি। তোমার চুলের ভেতর থেকে আমি প্রথম গোলাপটা পেয়েছিলাম। না?
রাস্তার ওপর থেকে কুকুরটা তখন বনের দিকে চলে গেল। পাতার মধ্যে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে রইল রাত্রির বাতাস, যেন সেও উর্ণ হয়েছে শুনবে বলে।
আমার মনের মধ্যে কে যেন বলে, ঐ তো গোলাপ। ঠিক যেমন তোমাকে দেখছি চম্পা, আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। রঙ, গন্ধ, সব। আমি হাত দিই, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি গোলাপ। তখন আমি চারদিকে গোলাপ দেখতে পাই। আমার মন বলে, হাত দিয়ে ছুঁলেই ওরা আমার হাতে এসে পড়বে। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে?
চম্পা তার বুকের পরে মুখ রেখেই বলল, না।
তোমার বিশ্বাস হয় না?
হুয়।
তোমার বাবা জিগ্যেস করলেন, আমি বলতেই পারলাম না।
চম্পা মুখ তুলে বলল, চলো, আমরা যাই।
কান্নার মতো করে উঠল ফিরদৌসির মুখ। শুধোল, কেন চম্পা?
আমার খুব দুঃখ। আমি খুব একা। আমি তো আর কিছু না, আমাকে ওরা আর্টিস্ট ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। বাবাও না। বাবার জন্যে জহিরকে আমি কিছু বলতে পারি না। আমাকে মুক্তি দাও। আমাকে নিয়ে চলো তুমি।
তখন ফিরদৌসি হাসল। ছিঃ, দুঃখ থেকে পালায় না চম্পা। দুঃখ থেকে আনন্দ আনতে হয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চম্পা। আনমনে বাতিটা নিয়ে বড় করে, ছোট করে। ব্যাকুল দুচোখ মেলে ফিরদৌসি বলে, আমার গোলাপ চম্পা আমি তো জানি নেই। তবু ভেতর থেকে যখন খুব বিশ্বাস হয়–আছে, তখন হাত দিলেই পাই। পালাবে কেন? দুঃখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো–ঐ তো, কই দুঃখ? ঐ তো, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো চম্পা, ঐ তো তোমার সব আনন্দ ফুলের মতো হাসছে। ছিঃ, পালাবে কেন?
চম্পাকে আবার বুকের মধ্যে টেনে নিল ফিরদৌসি। তখন চম্পার মনে হল, তার আর কোন দুঃখ নেই। তার যাযাবর জীবনে একাকীত্ব নেই, বাবার পেশায় আত্মদানেও বেদনা বা জ্বালা নেই, জহিরের লোভাতুর হৃদয়টাও যেন তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। বেঁচে থাকার প্রবল তাগিদে যে পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে চম্পা, বেঁচে থাকার জন্যে যতো মৃত্যুকে তার স্বীকার করে নিতে হয়েছে, সব এই মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল এক অখণ্ড গৌরবে, অহংকারে।
ফিরদৌসি বলল, কেউ বিশ্বাস করবে না চম্পা।
চম্পা বলল, হ্যাঁ কেউ বিশ্বাস করবে না।
সেই রাস্তায় ফিরদৌসি দেখতে পেল চম্পা তার পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এবার আর কোথাও থামল না, একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারা দুজন। বাতাস আবার সরসর করতে লাগল জামরুলেব পাতায়। বাদুর–তাড়ুয়া টিন আবার সারারাত টন্ টন করতে লাগল। বনের মধ্যে পাতায় ছাওয়া নিবিড় একটা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকল সেই কুকুরটা।