কদিন পরে দলে যখন একটু পুরনো হল সে তখন খুচরা জিগ্যেসাবাদ শুরু হল। কখনো সামাদ, কখনো ব্যাপার্টির চারমূর্তি, কনো জহির। দলের পশার বেড়ে গেছে ফিরদৌসি যোগ দেবার পর, রোজ নতুন বায়না আসছে, জহিরের এটা সহ্য হয় না। ফিরদৌসির দিকে তার তাচ্ছিল্য তাই দিনে দিনে বাড়ছিল, আর মনে মনে ভাবছিল গুণটা জেনে নিতে পারলে ঘাড় ধরে নাবিয়ে দেয়া যেতো রাস্তায়। জহির একে ওকে লাগায়। তাদের প্রশ্ন শুনে ফিরদৌসি ম্লান হাসে, বিব্রত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। যেন এদের ভাষাটাই সে বুঝতে পারছে না। চম্পার জন্যে মনটা তার কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে, কারণ চম্পা তাকে জিগ্যেস করে না, তার গোলাপ দেখে অবাক হয় না। ফিরদৌসি যেন বুঝতেই পারে না, তার গোলাপ দেখে এতো অবাক হবার কী আছে?
এদিকে আরো ব্যাপারে শান্তিটুকু বলতে নেই জহিরের। সেদিন সেই রাতের পর চম্পা তাকে আর দশ হাতের মধ্যে আসতে দেয় না। হাসতে গেলে মুখ আঁধার করে ফেলে, কথা বললে উত্তর দেয় না। চম্পাকে আর একা পাওয়া যায় না। রক্তে যে আগুন ধরেছে সে রাতে, থেকে থেকে তা জহিরকে এমন করে পোড়ায় যে মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যায়। তখন মোদক দুচার দলা মুখে না দিলে শরীরটাতে আর ঝিম আসে না। কেন যেন তার সব রাগ গিয়ে আরো বেশি করে পড়ে ফিরদৌসির ওপর।
একদিন প্রফেসরকে বলেই ফেলল জহির, ওস্তাদ, আমরা না হয় ফ্যালনা চ্যালা। আপনাকে তো সে গোলাপের গুণ বলতে পারে। আমরা না হয় দেমাক সইলাম, আপনাকে যে ব্যাটা অপমান করছে, এটা আমাদের সহ্য হয় না। সাচ্চা সাকরেদ হয়, বলুক সব খুলে আপনাকে।
প্রফেসর তাকে শান্ত করলেন বুঝিয়ে। নিজেও ভাবলেন, সত্যি, আমাকে অন্তত ফিরদৌসির বলা উচিত। পুরনো সাকরেদ জহির, তার দিকে টান আছে বলেই না যে কথা তিনি খেয়াল করেননি, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে গেল।
তখন শো হচ্ছিল নিলফামারীতে। এক রাতে শো শেষে ফিরদৌসিকে নিজের ঘরে ডেকে এনে দোর বন্ধ করে তিনি জিগ্যেস করলেন, তোমার গুণটা আজ আমাকে বলো। আর কিছু না।
ফিরদৌসি অবাক হয়ে চোখ তুলল। যেন এতোদিন ধরে ফিসফাস চলছে তার বিরুদ্ধে এইটে সে আজ হঠাৎ বুঝতে পেরেছে।
ফিরদৌসি।
কী?
বলো।
চুপ করে রইল সে। তখন প্রফেসর কাঁধে হাত রেখে অভয় দিলেন, এখানে কেউ নেই। কেউ জানবে না। আমি কসম করছি ফিরদৌসি, কাউকে বলবো না তোমার গুণ। বলো।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন প্রফেসর। তবু কোন জবাব নেই। তখন অন্য পথ ধরলেন, দ্যাখো ফিরদৌসি, আমাকে তুমি ওস্তাদ মানো?
জি।
দলে নেবার সময় তোমাকে হাত ধরে সাকরেদ করেছিলাম?
জি।
ওস্তাদকে না বলা, তার কথার অবাধ্য হওয়া, ভাল?
চৌকির ওপর বসে বসে ঘামতে লাগল ফিরদৌসি। বিছানার ওপর প্রফেসরের যাদুর লাঠিটা পড়েছিল, খামোকা সেটা নাড়তে লাগল। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল তার গায়ে নানা রংয়ের আংটিগুলো। বুক ফেটে যেতে লাগল ফিরদৌসির। কিন্তু কথা বলতে পারল না।
তখন প্রফেসর নিরাশ হয়ে তার শেষ অস্ত্র ছাড়লেন। বললেন, আমার শো–এর সব খেলার গুণ আমার জানা। এ না হলে দল চলে না। জহির, সামাদ, চম্পা– এরা সবাই আমার হাতে গড়া আর্টিস্ট। সবাই আমাকে জানাতে বাধ্য। তোমার বেলায় এতোদিন জানতে চাইনি, ভেবেছিলাম নিজেই বলবে। আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে একদিন। এতোদিন হয়ে গেল, এখনো যদি না বলো আর চলে না। দলের সবাইকে আমি বলবো কী?
উৎকর্ণ হয়ে প্রফেসর জিগ্যেস করলেন, কী, কী বললে?
একটা উত্তর দিয়েছিল ফিরদৌসি। আবার সে বলল, তেমনি অস্ফুট স্বরে, তাহলে, আমি বরং চলেই যাই।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন প্রফেসর। বলে কী! চলে যাবে। আর একটা কথা বলতে পারলেন না তিনি। মনে হল, ডান হাতখানা কে কেটে নিয়ে গেল। চোখের সমুখে লাফিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠল আবার সেই ছবি হলে দর্শক নেই, দুবেলা শুধু খিচুড়ি, পোশাকে তালির পর তালি পড়ছে, ট্রেনের টিকেটের পয়সা নেই। ফিরদৌসি আসবার পর গত দুমাসে পশার এতো বেড়েছে, পয়সার ঝনঝন এতো দীর্ঘ হয়ে উঠেছে যে, সে কখনো চলে যাবে, যেতে পারে, এটা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখছিলেন পাকিস্তান যাবেন, ইরান–তুরান যাবেন, বিলাত আমেরিকায় শো করবেন, পাল্লা দেবেন পি.সি, সরকারের সঙ্গে সব যেন দপ করে নিবে গেল ফিরদৌসির একটা মাত্র কথায়।
ফিরদৌসি আস্তে আস্তে চৌকি ছেড়ে উঠে, দরোজা খুলে, বাইরে মধ্যরাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অসহায়ের মতো বোবা চোখে সেই অসম্ভব তাকিয়ে দেখলেন প্রফেসর নাজিম পাশা।
চম্পা এ ঘরে এসেছিল, অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল। বাবা নিঃশব্দে কাঁদছেন। বসে আছেন। চৌকির ওপর, দুটো হাত হাঁটুর ওপর রাখা, কেঁপে কেঁপে উঠছে সারা শরীর। বাবাকে আজ কাঁদতে দেখে সত্যি অবাক হল চম্পা। কারণ বাবা গত দুমাসে একদিনও কাঁদেনি। চম্পা ভুলেই যেতে বসেছিল বাবার ওই শিশুর মতো কান্নার স্বভাবকে। আজ কেন যেন তার অশ্রু ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। বড় দুর্বল মনে হল নিজেকে। মনে হল, তার কেউ নেই। আর দাঁড়াতে পারল না সেখানে, দেখতে পারল না বাবাকে; চৌকাঠের বাইরে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল চম্পা।
পটকা বিছানা বগলদাবা করে শুতে যাচ্ছিল, চম্পাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করল, কী?