চম্পা দৌড়ে এসে শুধোল, কী বাবা, কী হয়ে গেছে?
প্রফেসর বললেন, নাম। ঘুমিয়ে আছি, স্বপ্ন দেখলাম, যেন একটা ভারি সুন্দর জায়গায় চলে গিয়েছি, বুঝলি? লোকে বলল, এটা বেহেশত। ন্নাত। হঠাৎ দেখলাম একটা বাগান। হাজার হাজার গোলাপ। হাসছে, ঝলমল করছে, লাল রঙটার ভেতর থেকে আলো বেরুচ্ছে যেন। আর কস্তুরীর মতো ঘ্রাণ। চম্পা, এ রকম অবাক কাণ্ড জীবনে দেখিনি। যখন তুই মায়ের পেটে, তখন তোর মা এরকম স্বপ্ন দেখেছিল। বলতে বলতে গাঢ় হয়ে এলো তার কণ্ঠ, উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ। তিনি বলে চললেন, আমাকে জাগিয়ে তুলে তোর মা বলল, আমি বেহেশতকে ফিরদৌসও বলে কি–না, তাই ও নামটা পছন্দ হয়েছিল তার।
চম্পা বলল, তার বদলে হলাম আমি। মা কী বলল তখন?
তোর মার কি আর মনে ছিল? বলে, আমারই ছিল না। ফুটফুটে দেখে তোর নাম রাখলাম চম্পা? হঠাৎ আজ মনে পড়ল। কী আশ্চর্য আল্লারাখার নাম নিয়ে সকালে এতো জল্পনা করলি। নাম রেখে দে ফিরদৌসি। কী বলিস? ওর খেলার সঙ্গে মানাবে ভাল।
স্ত্রী যে নামটা একদিন পছন্দ করেছিলেন সেটা কাউকে দিয়ে দিতে যেন তার সংকোচ করছে। যেন ঘরের জিনিস না বলে না কয়ে দান করে দিচ্ছেন। চম্পার মুখের দিকে তাই উদগ্রীব হয়ে তাকালেন তিনি। যেন চম্পা বললেই নিজের আর অপরাধ থাকে না। চম্পা বলল, চমৎকার! কী যে নাম রেখেছিল ওর বাপ–মা, হাসি পায়, না বাবা?
চম্পা নিজেই গিয়ে খবরটা দিয়ে এলো আল্লারাখাকে। বলল, আজ থেকে ফিরদৌসি বলে সব সময় ডাকা হবে। ডাকলে যেন সাড়া পাই।
আচ্ছা। বেশ নাম। আল্লারাখা তখন কোথা থেকে চামড়া এনে কালকের পুড়ে যাওয়া ড্রাম মনোযোগ দিয়ে মেরামত করছিল।
সে রাতের শো–এ সমস্ত আইটেম যখন শেষ হয়ে গেল, তখন প্রফেসর নাজিম পাশা স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার তালি দিলেন। এরপর ঘোষণা করলেন, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের শেষ আইটেম রক্তগোলাপ। করতালিতে ভরে উঠল টাউন হল। সাত আসমান আর দো–জাহানের লাখো কুদরৎ–এর এক কুদরৎ রক্তগোলাপ– একটানা উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন প্রফেসর নাজিম পাশা–সারা দুনিয়ার বড় বড় যাদুকর, বড় বড় ম্যাজিশিয়ান, বড় বড় কুদরতি কামেল পর্যন্ত এ খেলার সন্ধান জানে না। শত শত বৎসরে একজন মাত্র একজনকে এই অদ্ভুত মায়া শক্তি দেওয়া হয়। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য রক্তগোলাপ। বাগান লাগে না গাছ হয়; পানি লাগে না বড় হয়; দুনিয়ার সাত ভেজালে বাধা চোখ দিয়ে সে ফুল দেখা যায় না। সেই ফুল, সেই রক্তগোলাপ দেখাবেন আজ আমার প্রিয় সাকরেদ ফিরদৌসি। ব্যাণ্ডপার্টি প্রবল বিক্রমে শুরু করল বাজনা, শ্বাসরুদ্ধ করে বসে রইল দর্শক, প্রফেসর বাজনার তালে তালে বলে চললেন, ফিরদৌসি আমার প্রিয় সাকরেদ–রক্তগোলাপ। ভাগ্যবানেরা একটি করে পাবে বাড়ি নিয়ে যাবেন খোশবুতে ভরে উঠবে ঘর। বিলাত থেকে তোক এসেছিল, আমেরিকা লক্ষ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিল, জাপান হাওয়াই জাহাজ পাঠিয়েছিল, তবু আমার সাকরেদ ফিরদৌসি তার দেশ ছেড়ে যায় নাই। বন্ধুগণ, টাকা দিয়ে কেনা যায় না, সাধনা করে পাওয়া যায় না, সাত আসমান আর দো–জাহানের লাখো কুদরৎ এর এক কুদরৎ রক্তগোলাপ।
স্টেজে এসে তখন দাঁড়াল ফিরদৌসি। নীরবে নত হয়ে সালাম করল। পর মুহূর্তে তার হাত দুটি রূপান্তরিত হল বিদ্যুতে। ঝড়ের মতো উৎক্ষিপ্ত হতে লাগল গোলাপ, বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল, ঝর্ণার মতো নাচতে লাগল অসংখ্য গোলাপ। করতালিতে মুখর হয়ে উঠল হল।
কড়িগ্রাম থেকে ডেরা তুলবার আগে প্রফেসর আবার তার প্ল্যাকার্ড আঁকিয়ে নিয়েছেন ওখানকার একমাত্র সাইনবোর্ড লিখিয়ে জীবন রায়কে দিয়ে। এবারে প্ল্যাকার্ড আরো বড় করা হয়েছে। তার মাথায় এবার আঁকা হয়েছে ফিরদৌসি আর রক্তগোলাপের চিত্র। পয়সা নামমাত্র নিয়েছেন জীবন বাবু, পরিবার নিয়ে সামনের সারিতে বসে সেকেণ্ড অফিসার, সার্কল অফিসারদের সঙ্গে শো দেখতে পেয়েছেন ফ্রি পাসে, তাতেই খুশি। ফিরদৌসি তাঁকে একটা বড় গোলাপ দিয়েছিল স্টেজ থেকে নেমে এসে, সেইটে দোকানে রেখেছেন তারপিনের খালি শিশিতে পানি ভরে, জিইয়ে। রাস্তার লোক ধরে ধরে গল্প করলেন কদিন, বুঝলে হে। সবাইকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল, আমাকে দেখে একেবারে নেমে এসে– দেখছইতো কতো বড়, এতো বড় আর কেউ পায়নি।
লোকেরা তাজ্জব হয়ে দেখে আর মাথা নাড়ে। কেউ কেউ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। বলে, একেবারে সত্যি গোলাপ হে! সেইটেই আশ্চর্য। বোজ বোজ এতো গোলাপ আসে কোত্থেকে?
উত্তর দিতে পারে না কেউ। নানারকম গুজব। একেকজনে একেক কথা বলে। কিন্তু কারো কথাই কাজের মনে হয় না। সবাই চোখ চাওয়া–চাওয়ি করে। সত্যিই তো, এতো গোলাপ আসে কোথা থেকে? যতই বলুন প্রফেসর নাজিম পাশা, বাগান লাগে না গাছ হয়, লোকরা মনে মনে কল্পনা করতে থাকে মাইল দুমাইল জুড়ে এক বিরাট বাগানের।
দলের কাছেও এ এক বিরাট রহস্য। ফিরদৌসির গুণটা কোথায়? প্রথম কদিন কেউ তাকে জিগ্যেস করতে সাহস পায় না। সাহস ঠিক নয় সুযোগ হয় না। বলতে গেলে কারো সঙ্গে কথাই বলে না ফিরদৌসি। কখন বসে একটুখানি খেয়ে নেয়। সারাদিন একটা পাতা কী কাঠি কী ফড়িং যা পায় তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখতে থাকে, যেন এই প্রথম দেখছে। শো র সময় আরেক কাণ্ড! পোশাক পরবার পর থেকে হাত পা কাঁপতে থাকে। ভীষণ ভয় করতে থাকে তার! ঠোঁট শুকিয়ে যায়। তারপর খেলা দেখিয়ে মরা একটা মানুষের মতো গা হাত পা ছেড়ে শুয়ে থাকে, সংকুচিতভাবে, চোরের মতো, বারান্দায় কী স্টেজের এক কোণায় বিছানা পেতে। একটু ভাল ঘর, বিছানা, খাওয়া দিতে গেলে বা কেউ কথা বললে বিব্রত হয়ে পড়ে, বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এ মানুষকে জিগ্যেস করাও ঝকমারি। কদিন সবাই চোরা নজরে রাখে ওকে, যদি রক্তগোলাপের হদিশ পাওয়া যায়। তাতেও কোন লাভ হয় না। এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও যায় না ফেরদৌসি, চোখের আড়াল হয় না। সামাদ একদিন সারারাত জেগে পাহারা দিয়েছে। নাঃ, ঘুম থেকে একবারও কোথাও উঠে যায়নি ফিরদৌসি। জহির, যে জহির প্রথম দিন মেসমেরিজম বলে তুচ্ছ করেছিল, ভাবনায় পড়েছিল সেও। আসলে সেও বুঝতে পেরেছে, এ মেসমেরিজমের কর্ম নয়। তাহলে গুণটা কোথায় ফিরদৌসির?