উত্তম, উত্তম প্রস্তাব।
অলবানি স্ট্রীটের এই বিশাল তেতলা বাড়িটি বহুদিন খালি পড়েছিল। লন্ডনে এমন বহু বাড়ি আছে, কোনো কারণে খালি। প্রধান একটা কারণ, মালিক বেশি ভাড়ার আশায় ফেলে। রাখে। আরেকটা বড় কারণ, পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বহুতল দালান ওঠানোর অনুমতি পাওয়া নিয়ে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে টানাহেঁচড়া চলে, সেই অবসরে বাড়িটি থাকে খালি পড়ে।
কিছুদিন থেকে একটা হাওয়া বইছে। কিছু তরুণ-তরুণী, কিছু দম্পতি একসঙ্গে মিলে এই সব বাড়ি দখল করে বিনাভাড়ায় বাস করছে। তরুণ-তরুণীদের আধকাংশই এক ধরনের আদিম ও মৌলিক জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। এরা যতদিন পারে সরকারের কাছ থেকে বেকার ভাতা নেয়। যখন বেশি চাপ আসে একটা কোনো কাজ জুটিয়ে নেয়, রেস্তোরার কাজ, রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজ, দেয়ালে রঙ বা কাগজ লাগাবার কাজ, বড়লোক বাড়ির বাগান পরিষ্কার রাখবার কাজ। বিধিবদ্ধ সামাজিক জীবন-যাত্রার প্রতি এদের চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা। যে-কোনো আচার বা আনুষ্ঠানিকতা এদের চোখের বিষ। একে অপরের জিনিস ভাগ করে ব্যবহার করে, প্রায়ই জোড়া পাতিয়ে নেয়; স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করে, কখনো খায় কখনো খায় না। নিয়মিত গ্রহণের ভেতরে গাঁজা বা চরস জাতীয় কিছু।
ইয়াসমিনের বন্ধু এবং বান্ধবীদের ভেতরে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যে কয়েকজন, তারা সকলেই। একে একে লেখাপড়া ছেড়ে, বাবা বা মায়ের বাড়ি ছেড়ে অলবানি স্ট্রীটের এই বাড়ির তেতলায় এসে জায়গা নিয়েছে আজ বেশ কয়েক মাস। নিচের দুটি তলাতেও এ ধরনের। কিছু দল আছে। আসলে, আগে থেকে যারা পরিচিত, তারা এখানে এসেও সূত্রটা রক্ষা করে বলে ছোট ছোট দলে তারা ভাগ করা মনে হয়। সবাই আবার এক সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন বসে বাড়ির ভালোমন্দ, পানি বিজলী নিয়ে আলোচনা করে। পুলিশি উৎখাত উৎপাতের মোকাবেলা করা যায় কী করে, আলাপ করে।
মায়ের কাছে বন্ধুর জন্মদিনের কথা মিথ্যে বলে ইয়াসমিন সোজা চলে আসে অলবানি স্ট্রীটের তেতলায়। তাকে দেখে হৈচৈ করে ওঠে পিটার, ভিনসেন্ট, জো, গ্যাবি, কোকো, প্যাম, এমনকি স্বভাবতই যে চুপচাপ থাকে, রাতে গোরস্তানে গিয়ে গিটার বাজায়, সেই মার্ক পর্যন্ত খুশি হয়। এরা সকলেই এক ইস্কুলে পড়াশোনা করত। এদের দলে এতদিন নাম লেখায় নি কেবল ইয়াসমিন।
সন্ধে বেলায় এসে প্রথমে সে বলে নি, বাড়িতে আর ফিরবে না বলেই সে এসেছে। সমস্ত সন্ধে-রাত, দুপুর-রাত পর্যন্ত ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে যাবার পর, গ্যাবি আর ভিনসেন্ট, কোকো আর পিটার, প্যাম আর জো, একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে জুটি বেঁধে যাবার পর ইয়াসমিন ভীষণ একা বোধ করতে থাকে। তার একবার মনে হয়, বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু এদের মুক্ত এই জীবন তাকে আয়নার মতো আকর্ষণ করে রাখে। দূরে, একা, আপনমনে গিটার বাজাচ্ছিল মার্ক। সে ধীরে এগিয়ে আসে ইয়াসমিনের কাছে এবং একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বন্ধুদের সান্নিধ্যে নিঃসঙ্গ বোধ করিও না। তারপর আর কিছু না বলে গিটার নিয়ে কিছুক্ষণ টুংটাং করে খসখসে গলায় গান ধরে মার্ক। কথাগুলো ইয়াসমিনকে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
অদ্যই আগামীকাল, আগামীকালই অদ্য। জনুই মৃত্যু এবং মৃত্যুই জীবন। সম্পদই দারিদ্র্য দারিদ্রাই সম্পদ। বন্ধু উপলব্ধি করিলেই তুমি আমার বন্ধু। তোমারও স্থান আছে হেঁড়াকোটের তলায়।
মানুষের চোখে চোখ— ইন্দ্রজাল। জলের গভীরে মাছ ইজাল। শব্দের অতলে নীরবতা— ইন্দ্রজাল। বন্ধু, কোলাহল থামলেই তুমি আমার বন্ধু। তোমারও স্থান আছে হৃদয়ের আগুনের পাশে।
সারারাত ঘুমের ভেতরেও গানটি শুনতে পায় ইয়াসমিন। সকালে জেগে উঠে নিজেকে যখন সে আবিষ্কার করে তারা সকলে মেঝের ওপর গোল হয়ে ঘুমিয়ে আছে তখন সে আপন মনেই বলে ওঠে, ইহা সুন্দর, ইহা কী সুন্দর!
তারপর ঘুম থেকে উঠে সবাই গোল হয়ে যোগাসন করতে বসে। ইয়াসমিনের অভ্যেস নেই, তবু সেও তাদের অনুকরণ করে। ভিনসেন্টের নেতৃত্বে আধঘণ্টা ধ্যান শেষ হবার পর ইয়াসমিন সোজা উঠে গিয়ে তাকে বলে, এই আমার বাসগৃহ। আমাকে তোমরা গ্রহণ করিবে?
ভিনসেন্ট ঘোষণা করে, হাততালি থেমে যাবার পর, অতঃপর ইয়াসমিন জন্মগ্রহণ করিবে। আমরা সেই স্বর্গীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিব।
এই দলটির প্রধান হিসেবে ভিনসেন্টকে সকলেই মান্য করে। বয়সেও সে সকলের চেয়ে বড়। তার বাবার অবস্থাও অত্যন্ত ভালো। বাবা বিলেতের সবচেয়ে নামকরা স্থপতি। ভিনসেন্টের মতে, তিনি মানুষের জন্যে কারাগার নির্মাণ করেন। উন্মুক্ত আকাশ নির্মাণ করিবার ক্ষমতা তাহার নাই।
ভিনসেন্ট এখন অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেয়। দলনেতা হিসাবে সে তার জুটি গ্যাবিকেই জননী হিসাবে মনোনয়ন করে।
ভিনসেন্ট ঘোষণা করে, তোমরা দেয়াল ঘেঁষিয়া চক্রাকারে উপবেশন কর। পদ্মাসনে তন্তয় হও। অতঃপর, গ্যাবি, এই রমণী, বিশ্বজননী হইল। ইয়াসমিন, নিকটে আইস। তুমি কি এই রমণীকে চিনিতে পার?
ইয়াসমিন ঠিক বুঝতে পারে না, কী তার উত্তর হওয়া দরকার। সে নিজেকে তুচ্ছ ও অসহায় বোধ করতে থাকে।
ভালো করিয়া অবলোকন কর। অনুমান হয়?
গ্যাবি গোল চক্রের মাঝখানে ধ্যাননেত্রে বসে আছে। তার কাঁধের দু পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সোনালি দীর্ঘচুল। মুখখানি একই সঙ্গে কোমল ও কঠিন বলে মনে হচ্ছে। ইয়াসমিন হঠাৎ যেন এতদিনের চেনা গ্যাবিকে চিনে উঠতে পারে না। মুহূর্ত কালের জন্যে তার ভয় হয়। সে পাশে তাকাতেই মার্ক হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে তার কানে কানে বলে, বল, হাঁ, চিনিতে পারিতেছি। ইনিই আমার গর্ভধারিণী।