পথের দিকে চোখ রেখে বারী ভ্রু কুঁচকে রাখে।
ভাইয়ান বলে, লন্ডনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
নতুন কোনো হাসপাতালে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন নাকি? ও আশাও করবেন না। স্কটল্যান্ডের ডাক্তারদের ইংল্যান্ডে সহজে কাজ হয় না। সে ইংরেজই হোক, আর আমরাই হই।
ভেতরের কথাটা বলতে গিয়েও ইতস্তত বোধ করে ভাইয়ান। একটু লজ্জাও করে। তাই সে আপাতত সেটাকে চাপা দিয়ে নগদ প্রসঙ্গেরই জের টেনে বলে, জানি। পাকিস্তানিদের আমরা বলতাম ইস্ট পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখে, এখানেও কম নয়। যতবার লন্ডন থেকে গাড়িতে করে ফিরে গেছি স্কটল্যান্ডে, বোঝাই যায় কখন স্কটল্যান্ডে ঢুকে পড়েছি। রাস্তাগুলো গরীব, সার্ভিস স্টেশনগুলো বাজে, বাড়িঘর সাধারণ। তফাতটা স্পষ্ট বোঝা যায় ইংল্যান্ড থেকে। তাই না?
স্কটল্যান্ড তো এখন স্বাধীন হবার কথা ভাবছে। নর্থ সি-তে তেল বেরিয়ে গেছে, আর ঠেকায় কে?
একটা জিনিসের জন্যে আমার অবাক লাগে, এদের প্রতি শ্রদ্ধা হয়। স্বাধীনতার কথা এরা খোলাখুলি বলতে পারছে, আর আমাদের দেশে বললে ফাঁসি। মিথ্যে একটা মামলাই করে দিল শেখ মুজিবের নামে আইয়ুব খাঁ।
ইংরেজও করে। নিজের দেশে বলে মুখোশটা ঠিক রেখেছে। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে কম করেছে সাহেব? আইয়ুব খাঁ তো তাদেরই ট্রেনিং পাওয়া। হঠাৎ মনে পড়ে যায় বারীর। মুহূর্তের জন্যে পথ থেকে চোখ ফিরিয়ে ভাইয়ানকে দেখে নিয়ে, আবার সমুখে চোখ রেখে বলে, কই বললেন না তো, লন্ডনে আপনার উদ্দেশ্যটা? তাহলে নির্জলা ছুটি নয়?
রুহুল কুদ্দুসকে চেনেন তো? সেই যে সেভেন্টি-ফোরে ডাবলিনে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখা হলো। এক চান্সে এম-আর-সি-ও-জি হয়ে গেল?
খচ করে বুকের ভেতরে লাগল কথাটা। বারী বহু বৎসর ধরে পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারে নি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
হাঁ, মনে আছে।
রুহুল কুদ্দস এক মেয়ের খবর দিয়েছে।
মেয়ে?
বাঙালি মেয়ে। বাবা-মা অনেকদিন এদেশে আছে। বাবার ট্রাভেল এজেন্সি আর দেশে মাল পাঠাবার ব্যবসা।
দ্রুততম তৃতীয় লেন ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির প্রথম লেনে গাড়ি সরিয়ে আনে বারী। মেয়ে দেখেছেন?
না, সেই দেখতেই যাচ্ছি। আমিও আপনার মতো ডাক্তার সাহেব, বিয়ে বাঙালি ছাড়া করব
না। রুহুল কুদুস বলল, মেয়েটি নাকি ভালো। বাবা-মা দুজনে বহুদিন এসে থাকলেও এখনো পুরোদস্তুর বাঙালি। তা রুহুল কুদুস আবার থাকতে পারছে না, তার কী কাজ আছে। তাই আপনাকে নিয়ে এলাম। একটা ওপিনিয়ন দিতে পারবেন। অনেকদিন তো আমাকে চেনেন, আমার সবই আপনার জানা। কী রকম বৌ চাই, আপনি ভালো বুঝবেন। বারী আবার ধীরে ধীরে তৃতীয় লেনে গাড়ি নিয়ে যায়। যেতে যতক্ষণ লাগে সে কিছু বলে না। তারপর দ্রুত গতিতে স্থির হয়ে বলে সেই মেয়েটির কী হলো?
অ্যান?
চুপ করে থাকে বারী। অপেক্ষা করে উত্তরের জন্যে।
ভাইয়ান বলে, ডাঃ খলিলের কথা মনে আছে? হার্ট উড হাসপাতালে ছিল, সেখানে নার্স বিয়ে করেছিল, ক্যাথি নাম?
হাঁ।
বিয়ের পর খলিলের অবস্থা দেখে আমার আর ইংরেজ বিয়ে করবার সাধ নেই। দেশে টাকা। পাঠান তো বন্ধই করেছে, দেশেও যায় না আজ তিন বছর। দেখলে আর চিনতে পারবেন না খলিলকে। পাকা ইংরেজ। আমাদের এখন যে সব শুনতে হয়, শুনে মনে হয়, বাংলাদেশে তার জন্ম নয়। অ্যা
নের সঙ্গে তো বেশ ঘুরতেন। একবার বললেন না, ভালোবাসেন?
ভাইয়ান লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে, পা সমুখে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বাধা পেয়ে, পা আবার গুটিয়ে বলে, সে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরলে ও রকম মনে হয় ডাক্তার সাহেব। তাছাড়া দেখুন না, দেশে কোনো ডাক্তার নার্স বিয়ে করলে ছি ছি পড়ে যায়, ডাক্তারেরাই যেন এক ঘরে করে রাখে। এখানে শাদা চামড়া বলেই নার্স উচ্চপদবাচ্য হয়ে গেল? অনেক ভেবে দেখলাম বারী সাহেব, নাহ, বিয়ে করলে বাঙালি। আমার অন্তত ও সব পোষাবে না। বিছানায় নিজের দুদিন ফুর্তির জন্যে সারা জীবন দেশ ছেড়ে, বাপ-মা ভাই-বোন ভুলে বেকড বীনস আর সসজে খেয়ে থাকতে পারব না।
সেই জন্যে বাঙালি মেয়ে খুঁজছেন?
হাঁ, তাই আর কী। রুহুল কুদ্দুসও খুব করে বলল। ভাবলাম দেখেই আসি। দেখতে ক্ষতি কী?
নিজের উদ্দাম আগ্রহ, বারীকে আগে থেকে জানান না দিয়ে টেনে আনবার জন্যে বিবৃতি, এক সঙ্গে সব চাপা দেবার জন্যে ডাঃ ভাইয়ান গলায় তাচ্ছিল্যের সুর আনে। যেন, নেহাত একটা মজা করতে যাচ্ছে, বিয়েটা কোনো কথাই নয়।
ডাঃ বারী হঠাৎ জিগ্যেস করে, আচ্ছা সেই রুহুল কুদ্দুস এখন কী করে?
লন্ডনে কিং এডোয়ার্ড হাসপাতালের কনসালট্যান্ট।
বুকের ভেতরে আবার খোঁচা অনুভব করে বারী। ম্যানচেস্টার থেকে তাকে মেয়ে দেখার জন্যে না বলে নিয়ে আনার দরুণ ভেতরটা হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে তার। নীরবে সে গাড়ি চালাতে থাকে।
০৫. বজুলল করিম সাহেব আসবেন
দুপুরের পর যে-কোনো সময় বজুলল করিম সাহেব আসবেন ঢাকার টিকিট নিতে। টিকিট আনতে এক্ষুণি না বেরুলে নয়। মিস্টার আলি আপিস ঘরে ফিরে এসে শূন্য দৃষ্টিতে করিম সাহেবের নাম লেখা চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতক্ষণ নাহার আপিস ঘরেই বসেছিল। ঘর খালি রেখে যেতে পারে না। এখন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে মুহূর্তে বুঝে নেয়, মাহজাবীনের কাছ থেকে কোনো কিছু জানা যায় নি।