আলি উঠতে যাবেন, পেছনে শব্দ পাওয়া গেল।
নাহার।
জিজ্ঞাসু চোখে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকান। প্রশ্নটা এই, ইয়াসমিনের না চা নিয়ে আসবার কথা?
নাহারকে ইতস্তত করতে দেখে আলির মাথায় রক্ত চড়ে যায়। মেয়েটি নিশ্চয়ই বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছে। তাই নিচে নামে নি।
ইয়াসমিন কই?
আলি প্রায় সব সময়ই মেয়েদের পুরো নাম ধরে ডাকেন। এখন তো ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন।
তুমি না বললে তাকে পাঠিয়ে দেবে?
সে নেই।
নেই?
মানে বাড়িতে নেই।
বাড়িতে নেই মানে কী? বাড়িতে থাকবে না কেন? এই ভোরে ভোরে আবার কোথায় গেছে?
বোধহয় সে বাড়িতেই ফেরে নি।
চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কথাটার অর্থ মর্মে প্রবেশ করে। নেতানো গলায় প্রতিধ্বনি করেন তখন, বাড়িতে ফেরে নি।
মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন আলি। তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকান। মুহূর্তের জন্যে নাহারকেও তার অচেনা মনে হয়।
নাহার প্রস্তুত হয়ে থাকে স্বামীর যে-কোনো অভিযোগ, যে-কোনো চিৎকার শুনবার জন্যে।
সে জানে এক্ষুণি তিনি সমস্ত দোষ তাকেই দেবেন।
তার বদলে আলি দুঃখিত গলায় উচ্চারণ করেন, কোনো দিন তো এ রকম করে নি।
মেয়ের কুশলের চেয়ে পারিবারিক মর্যাদাহানীর আতংক আলির মাথায় বড় হয়ে থাকে। এবং ক্রমশ তা আরো বড় হয়।
এর অর্থ ভেবে দেখছ?
আমিও তো ভাবি নি, মিনা এ বলবে।
হঠাৎ দ্রুত পায়ে আলি উঠে দাঁড়ান। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে যান। ল্যন্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে ডাকেন, মাহজাবীন।
সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে আসে। আপাদমস্তক তাকে একবার দেখে নেন আলি। মেয়েটি এখনো রাতের শোবার পোশাক ছাড়ে নি। বুকের কাছে বোতামটা লাগিয়ে সে নীরবে অপেক্ষা করে।
আলি সরাসরি প্রশ্ন করে, ইয়াসমিন কোথায় বলিতে পার?
মাহজাবীন মাথা নাড়ে।
আমার সহিত আইস।
নিজের শোবার ঘরে আলি ঢুকে যান। মাহজাবীন তবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে যায়।
আসন লও।
মাহজাবীন কতটা ভয় পেয়েছে বলা যায় না। বড় বড় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে সে বসে পড়ে। বসবার পরও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় না।
আলি কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে বলেন, আমার ধারণা তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ।
চমকে মাহজাবীন বাবার দিকে তাকায়।
মিথ্যা নহে।
লুকাইও না। তোমরা শিশু। তোমরা ভবিষ্যত জান না। তোমাদের ভালোর জন্যেই বলিতেছি। আমাকে বল, ইয়াসমিন কোথায় গিয়াছে?
আমাকে বলে নাই।
সত্য?
সত্য বলিতেছি।
মাহজাবীনের দিকে আবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকান আলি। পনের বছরের এই মেয়েটির পক্ষে পরিষ্কার মিথ্যে কথা বলা সম্ভব কিনা, তাও বাবার জেরার মুখে, মনে মনে আলি আন্দোলন করেন। এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হন, মাহজাবীন মিথ্যে কথাই বলছে।
মাহজাবীন আমার দিকে তাকাও।
মেয়েটি চোখ তুলে পরক্ষণেই নামিয়ে নেয়।
আমার বিশ্বাস, ইয়াসমিন হইতে তুমি ভিন্ন। তুমি তাহার মতো নও। পিতামাতাকে তুমি শ্রদ্ধা কর, বাঙালি মেয়ের শালীনতাবোধ তোমার আচরণে আমি লক্ষ করিয়াছি। তুমি কি বুঝিতে পারিতেছ না, তোমার ভগ্নি আমাদের প্রত্যেকের মুখে চুনকালি মাখাইয়া দিতে অগ্রসর হইয়াছে?
মাহজাবীন চুপ করে থাকে।
তুই নিশ্চয় জানিস, ইয়াসমিন কেথায়? বল আমাকে, তোকে না বললেও, তুই নিশ্চয়ই কখনো কিছু শুনেছিস। একদিন হঠাৎ এ রকম কেউ করে না। বল আমাকে, কিছু মনে পড়ে তোর?
মাহজাবীন অন্তত এটুকু খুশি হয় যে, বাবা মনে মনে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে বলার অভিযোগটা তুলেই নিয়েছেন। নইলে এভাবে এখন মিনতি করতেন না।
মেয়ের পাশে এসে বসেন আলি।
কিছু কি মনে পড়িতেছে?
না ড্যাডি।
কিছুই কি মনে পড়ে না? ফোনে কোনো আলাপ? পত্র? অথবা, তাহার এমন কোনো বন্ধু এইরূপ বুদ্ধি জোগাইতে পারে?
বন্ধুর উল্লেখ করে নিজেই শিউরে ওঠেন আলি। তিনি একাধিক ইংরেজ তরুণের কণ্ঠ মনে করতে পারেন, যারা টেলিফোনে ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। বাড়ির টেলিফোনই আপিসের বলে, তিনি মেয়েদের কাউকে খুব বেশি ফোন ব্যবহার করতে দিতেন না। আলি জানেন, নির্দেশটা মেয়েদের বন্ধুরাও নিশ্চয়ই জানে। তা সত্ত্বেও যখন ফোন আসে, তখন খুব দরকারেই আসে, তা বোঝা শক্ত নয়। সেই দরকারটা কী? এমন কিছু যা তিনি জানতে পারেন নি কখনো।
মাহজাবীন?
আমি কিছুই স্মরণ করিতে পারিতেছি না?
গুরুত্ব উপলব্ধি কর?
হাঁ, ড্যাডি?
সমাজে মুখ দেখাইতে পারিবে?
না, ড্যাডি?
মাহজাবীন নিজেই খুশি হয়ে যায় উত্তরটা সাবলীলভাবে দিতে পারবার কৃতিত্বে। সমাজের উল্লেখে মাহজাবীনের সমুখে বাঙালি কিছু দম্পতির চেহারা ভেসে ওঠে, যারা, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, পাউন্ড জমায়, আনন্দ করে না, গান শোনে না, কারি রান্না করে, আঞ্চলিক বাংলা বলে যার অধিকাংশই তার বোধগম্য হয় না এবং যে-কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির দাম কতটা বাড়ল, কেথায় সুলভে কী পাওয়া যাচ্ছে, নতুন সামগ্রীটি কবে কত দামে কেনা হলো, এ আলোচনায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দুপুররাতে ঢেকুর তুলে বাড়ি ফেরে। এদের কাছে মুখ দেখাতে না পারল তো বয়েই গেল তার।
মনের ভেতরে খিকখিক করে হাসে মাহজাবীন। বোধহয় তার কিছুটা চোখে মুখে প্রকাশ পেয়ে থাকবে।
আলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, তুমি এখনো শিশু। তুমি উপলব্ধি করিতে পারিবে না। ইয়াসমিন আমাকে সাগরে নিমজ্জিত করিল। ডাক্তার আসিলে তাহাকেই বা কী বলিব? যথাসম্ভব করুণ ও দুঃখিত চেহারা তুলে মাহজাবীন বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
০৪. ম্যানচেস্টার থেকে নটার দিকে
ম্যানচেস্টার থেকে নটার দিকে রওয়ানা দিয়েছে ডাঃ ইউনুস ভাইয়ান। স্কটল্যান্ডের বেলশিলে কাজ করে সে, সেখানকার মাতৃসদন হাসপাতালে। একটানা চলে আসতে পারত লন্ডনে গাড়ি চালিয়ে। বহুবার লন্ডনে সে বেড়াতে এসেছে সোজা কোথাও না থেমে। এ যাত্রায় ম্যানচেস্টারে থেমেছিল ডাঃ বারীকে তুলে নেবার জন্যে। তার সঙ্গে শলা হয়েছে, দুজনে দুটো দিন লন্ডনে থাকবে, তারপর ভাইয়ান তাকে নামিয়ে দিয়ে বেলশিলে ফিরে যাবে।