ইয়াসমিন কি তাহলে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেছে, নাহার টের পায় নি?
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বাথরুম দ্যাখে। কেউ নেই ভেতরে।
তখন মাঝের ঘর, অন্য দু মেয়ের যৌথ শোবার ঘৱৈ আসে নাহার। ছোট মেয়ে নাসরিন শুয়ে শুয়ে চার্লি ব্রাউন কমিক বই পড়ছে। আর মাহজাবীন জানালার কাছে টেবিলের ওপর বসে, জানালার বাইরে মুখ করে নোখের রঙ ওঠাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। নাহারের পায়ের শব্দে দু মেয়ের কেউ ফিরে তাকায় না। ইয়াসমিনকে এখানেও না দেখে তার বুক হিম হয়ে যায়।
কিছুতেই সত্যি বলে মনে হয় না, ইয়াসমিন গত রাতে ফেরে নি।
মাথাটা ঘুরে উঠে একবার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নাহার। শূন্য দৃষ্টিতে ইয়াসমিনের পিঠোপিঠি মেয়ে মাহজাবীনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মাহজাবীন নোখের রঙ তুলতে তুলতেই বলে, মাম, আজ প্রাতরাশ খাইতে চাহি না। প্লিজ।
প্রায় ছুটির দিনেই মাহজাবীন ভোরে নাশতা করতে আপত্তি করে।
সপ্তাহের পাঁচদিন ভোরে ইস্কুলে যাবার আগে মায়ের কড়াচোখের নিচে বাটি ভর্তি দুধ সিরিয়েল গিলতে হয়, ছুটির দিনে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা দেখায় সে। এটা নতুন নয়। তবু, নাহারের মনে হয়, আজ এর বিশেষ একটা অর্থ আছে।
সে মেয়েকে বলে, কখন উঠেছিস ঘুম থেকে?
মাহজাবীন আপন কাজে ব্যস্ত থাকে। নোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে। জবাব দেয় না।
নাহার কিছুটা কঠিনম্বরে জিগ্যেস করে এবার–উঠেছিস কখন?
ছোট মেয়ে নাসরিন চার্লি ব্রাউনের বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে, আহ তোমরা কী শুরু করিলে বল তো? আমাকে পড়িতে দাও।
নাসরিনকে পড়বার অখণ্ড নীরবতা দেবার জন্য নয়, ভিন্ন কারণে নাহার মাহজাবীনকে বলে, বীনা, এদিকে শুনে যাও।
মাহজাবীন ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায়।
প্রাতরাশ নয়, প্লিজ।
এসো এদিকে।
নাহারের গলায় কী ছিল, মাহজাবীন টেবিল থেকে নেমে আসে।
পাশেই ইয়াসমিনের ঘর, দরোজা খোলা, ভেতরে ঢুকে দরোজাটা বন্ধ করে নাহার সরাসরি প্রশ্ন করে, মিনা কোথায়?
ঘরের চারদিকে ধীর চোখে মাহজাবীন তাকায়। নাহার রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে। পিঠোপিঠি বোন, হয়তো ছোটটি বড়-র গতিবিধি জানে। তার এক প্রকার বিশ্বাসও হয়, মাহজাবীন নিশ্চয়ই জানে।
গুডনেস, সে কি ফিরিয়া আসে নাই?
তাহলে আর তোমাকে জিগ্যেস করছি কেন?
মাহজাবীন বড় বড় চোখে মায়ের দিকে তাকায়।
আমি জানিব কী প্রকারে?
তুমি জানবে না তো কে জানবে? রাতদিন তোমাদের কথাবার্তা, হাসাহাসি।
তাহাতে কী? তাহার গোপনীয়তা তাহার কাছে।
কাল কার জন্মদিন ছিল?
আমি জানি না?
কিছু বলে নি?
আমার স্মরণ হয় না।
কোথায় যেতে পারে জানিস?
তাহার বন্ধুরা আমার নহে। অমি সংবাদ রাখি না।
নাহার গুম হয়ে যায়। একবার মনের ভেতরে চমক দিয়ে যায়, মাহজাবীন জেনেও গোপন করছে না তো? কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে নিষ্পাপ মনে হয়। চোখের ওপর। নোখ তুলে ধরে সে এখন নিরিখ করে দেখছে, রঙ ঠিকমতো উঠেছে কিনা।
ইয়াসমিনের শূন্য বিছানার ওপর বসে পড়ে নাহার।
বীনা।
মাহজাবীন মায়ের আতংকিত কণ্ঠস্বরে চোখ ফেরায়। রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে আন্দোলিত হয় সে। তারপর, আবার সে স্থিরতর হয়।
মাম, এমনও কি সম্ভব নহে ফিরিয়াছিল সত্য, প্রভাতে আবার বাহিরে গিয়াছে।
অনুমানটি লোভনীয় মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। বিশ্বাস করে নাহার, কিন্তু পর মুহূর্তেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
না, আমি খুব ভোরে উঠেছিলাম। বেরিয়ে গেলে টের পেতাম।
তবে আমি আর জানি না।
তোর বাবাকে এখন কী বলব?
বলিবে, প্রভাতে বাহির যায়। তোমাকে বলিয়া যায়। অথবা তুমি সাড়া পাইয়াছিলে।
মাথা নাড়ে নাহার।
না, তাকে আমি বলেছি, মিনা ঘরে আছে।
ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায় মাহজাবীন।
ড্যাডি সহসা কেন সন্ধান করিলেন?
আজ সেই ডাক্তার আসবে, বিকেলের দিকে। মিনা তোকে কিছুই বলে নি? তুই একটুও টের পাস নি?
সত্য, মাম।
কিছু যদি বলে থাকে, আমাকে বল।
জানিলে বলিতাম।
বোন ঘরে ফেরে নি, শুনে এত ঠাণ্ডা আছ কী করে?
নাহার তিরস্কার করে মেয়েকে।
মাহজাবীন ঘর ছেড়ে যেতে যেতে বলে, তাহার জীবন তাহার।
০৩. ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না
অনেকক্ষণ পরেও যখন ইয়াসমিন চা নিয়ে আপিস ঘরে এলো না, মিস্টার আলি বিরক্ত বোধ করেন। মেয়েটির কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই বাবা-মায়ের জন্য। বয়স সতের পুরো হয় নি, লেখাপড়া শেষ হয় নি, খাওয়া-পরা-জামা-কাপড়ের জন্য এখনো নির্ভরশীল, অথচ চলন দেখলে মনে হবে, কোনো এক অধিকার বলে বাবা মায়ের কাছ থেকে কর আদায় করে চলেছে, বাবা-মাকেই তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
আলি পেছনের দরোজার দিকে একবার তাকাল। দরোজার ওপারেই সিঁড়ি। সিঁড়িতে এখনো কোনো পায়ের শব্দ নেই।
যে বাঙালটি তাকে ফাঁকি দিয়েছে, মিস্টার খানকে ব্যবসা দিয়েছে, তার জিনিসের খসড়া তালিকা টেবিলে কাগজপত্রের ওপরেই পড়ে ছিল। আলি এখন সেটা নিয়ে ফাস করে ছিঁড়ে ফেলেন। বাঙালিদের দেশপ্রেম সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়ে, মনে মনে গোটা বাংলাদেশেরই ভবিষ্যত অভিশপ্ত বলে স্থির করেন।
তালিকাটি ছিঁড়ে ফেলবার পর দ্বিতীয় যে কাগজটি সমুখে মেলে থাকে, তাতে সব বড় হাতের অক্ষরে লেখা মি. বজলুল করিম, লন্ডন-ঢাকা-লন্ডন, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে যে-কোনো দিন। প্রথমে মনে পড়ে না। তারপর হঠাৎ লক্ষ হয়। ভদ্রলোক আজই আসবেন টিকিট নিতে। দেশে যাচ্ছেন। আলি তালিকাভুক্ত এজন্ট নন বলে তাকে নগদ টাকায় বিমান-আপিস থেকে টিকিট এনে খদ্দেরকে দিতে হয়। মিস্টার করিমের টিকিট এখনো আনা হয় নি। ভদ্রলোক বিকেলেই এসে হাজির হবেন। ঘড়ি দেখেন আলি। বিকেলে ডাঃ ভাইয়ান আসবে, কখন আসবে ঠিক নেই, ম্যানচেস্টার থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছে। টিকিট আনতে হলে এখন বেরুনোই ভাল। তিনি কি একবার ওপরে যাবেন? নাহারকে বলবেন। আপিস লক্ষ রাখতে? অজুহাতটা ভালো লাগে তার। ইয়াসমিন আসতে দেরি করছে কেন, ওপরে গিয়ে সেটাও যাচাই করা যাবে।