ভিনসেন্ট বলে, নতুন আসিয়াছ?
লোকটি হয় প্রশ্ন বুঝতে পারে না, অথবা ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। সে ঠোঁট চাটতে থাকে ঘন ঘন। পিটার বলে, আমার গিরগিটি স্মরণ হইতেছে।
জো বলে, বাদামি শুকরটি গিরগিটির জিড়া প্রাপ্ত হইয়াছে। প্রকৃতির কৌতুক অবলোকন কর।
লোকটি বেরুবার চেষ্টা করে। গলা তুলে দলের মাথার ওপর দিয়ে আশেপাশে পথিক সন্ধান করে। তখন ভিনসেন্ট তার গলা ধরে বলে, তুমি সহবাস করিবে? শ্বেতাঙ্গ বালিকার সহিত নিদ্রা যাইবে? কত আনিয়াছ?
সকৌতুক দল লোকটির উত্তরের অপেক্ষা করে। সহবাসের উল্লেখে লোকটির জিভ একবার বেরিয়ে আর বেরোয় না।
পিটার লোকটির কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়।
যথেষ্ট আনিয়াছ তো?
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে কোটের দুদিক চেপে ধরে ভাঙা গলায় চিৎকার করে ওঠে, সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত, সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত।
শক্ত থাবায় তার মুখ চেপে ধরে ভিনসেন্ট। সবার দিকে হেলে তাকিয়ে বলে, ইহা ইংরাজি বলে দেখিতেছি। হইবে না কেন? সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত তো।
সকলে নিচু পর্দায় হেসে ওঠে। লোকটি ইয়াসমিনের দিকে ভয়ার্ত করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, ছয় মাস পরে চলিয়া যাইব।
জো লোকটির পেটে ঘুষি দেয়। বলে, ছয় মাস সরকারি বৃত্তিতে শ্বেতাঙ্গ বালিকার সুখ লইবে? তবে এই লও। বলে, সে প্যামকে ধাক্কা দিয়ে লোকটির বুকের ওপর ফেলে দেয়। এবং পরক্ষণেই তাকে সরিয়ে দিয়ে লোকটির পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে বলে, তুমি আমার বান্ধবীর গায়ে হাত দিলে কেন?
ভিনসেন্ট তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। আর দমাদম তাকে লাথি ঘুষি মারতে থাকে জো আর পিটার। মেয়েরা দৃশ্যটাকে আড়াল করে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে, পাছে পুলিশ না এসে যায়।
থাবায় মুখ আটকানো থাকলেও লোকটির মুখ থেকে একটি আর্ত শব্দ বেরিয়ে আসে, বাবাগো।
ইয়াসমিনের কাছে শব্দটি বিদ্যুৎবেগে পরিচিত বোধ হয়।
লোকটির রক্তমাখা ঠোঁট থেকে আবার উচ্চারিত হয়, আর না, আর না।
ইয়াসমিনকে ভিনসেন্ট প্রশ্ন করে, সে কী বলিতেছে? বুঝিতে পার?
বুকের ভেতরে কেমন যেন করে ওঠে ইয়াসমিনের। ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে অপরিচিত মনে হয়। ভয়ে তার উত্তর আপনা থেকে গড়িয়ে পড়ে, যথেষ্ট হইয়াছে বলিতেছে।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি কোথা থেকে শক্তি পায়। নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে খানিক। নিমজ্জমান মুমূর্ষ মানুষও কাঠের টুকরো দেখে বল ফিরে পায়। লোকটি ইয়াসমিনের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে বাংলায় বলে, আপনি বাঙালি, আপনি আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।
এক ঝটকায় তাকে টেনে তোলে জো আর পিটার দুদিক থেকে। ভিনসেন্ট লোকটির দুই উরুর ফাঁকে প্রচণ্ড এক লাথি মারতেই লোকটি কোৎ করে ওঠে। ইয়াসমিনের দিকে আবার তাকায়। তার দৃষ্টিতে কী ছিল, ইয়াসমিন চোখ ফিরিয়ে নেয়।
লোকটিকে সংজ্ঞাহীন করে, তার পকেট থেকে টাকাগুলো নিয়ে দল অলবানি স্ট্রীটের দিকে গলা জড়াজড়ি করে এগোয়।
১৮. ঘুম আসে না ইয়াসমিনের
ঘুম আসে না ইয়াসমিনের। কেবলি সে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। লোকটির চেহারা নয়, কণ্ঠস্বর তার স্মৃতিতে বার বার ফিরে আসে। লোকটি যে পরিষ্কার বাংলা কথাগুলো বলেছিল, এখন তা ইয়াসমিনের কানে তীব্র ভাষায় রূপ নেয়। বাংলা কি ইংরেজি, সে আর সচেতন নয়।
ঘর অন্ধকার। মেঝের ওপর প্রত্যেকে জায়গা দখল করে শুয়ে পড়েছে মাথা পর্যন্ত কম্বল টেনে। ইয়াসমিনকে দরোজার কাছে জায়গা দেয়া হয়েছে। দরোজার ফাঁক দিয়ে হিস-হিস করে হিম বাতাসের স্রোত আসে। তার দরুণ শীতবোধ হয়।
হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কুণ্ডলী পাকিয়ে সে শীতের সঙ্গে লড়াই করে। কম্বল আনে নি, গায়ের কোট খুলে ওপরে দিয়ে দিয়েছে সে।
নিজেকে রিক্ত এবং ব্যর্থ মনে হয় তার। ব্যর্থতাই বড় হয়ে তাকে রোমশ জন্তুর মতো চেপে ধরে। সেই সঙ্গে আবার তার মনে হয়, অন্য কারো শরীর সে ধারণ করে আছে, তার পুরনো দেহ বিদায় নিয়েছে, এই দেহের কোনো সংকেতই বোধগম্য বা নিয়ন্ত্রিত নয়।
পায়ের শব্দ পাওয়া যায়।
অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে মার্ক এসে ফিসফিস করে বলে, আমার কম্বল লও।
অনুভব করে মার্ক কোট সরিয়ে নিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় তাকে। ইয়াসমিন মার্কের হাত ধরে থাকে কিছুক্ষণ। যেন সে এতক্ষণ উঁচু দালানের কার্নিশে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ একটা অবলম্বন পেয়েছে।
তুমি কী গায়ে দিবে?
আমি বসিয়া থাকিব।
ইয়াসমিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। শীত পরাজিত হয়। উষ্ণতা ফিরে আসে।
মার্ক, তুমি আছ?
হাঁ, আমি আছি।
আমি কাঁদিতে ইচ্ছা করি।
কাঁদিও না, কেন কাঁদিবে?
তুমি ইহাদের মতো নও। তুমি ইহাদের সঙ্গে আছ কেন?
মার্ক কোনো উত্তর দেয় না।
ইয়াসমিন এবার কম্বলের ঢাকা সরিয়ে মুখ বের করে ফিসফিস করে বলে, চল আমরা দুজনে কোথাও চলিয়া যাই। মার্ককে নীরব দেখে ইয়াসমিন আঘো উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে নাভীর নিচে ক্ষীণ অথচ গভীর একটা ব্যথা অনুভব করে, লোকটিকে তখন প্রহার করবার স্মৃতি ফিরে আসে, এই ব্যথাবোধ মানসিক এবং তারই সহানুভূতিতে বলে ইয়াসমিন মনে মনে ব্যাখ্যা করে নিয়ে, মার্কের হাত ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে বলে, যাইবে মার্ক?
না, যাইব না।
তুমিও কি আমার ত্বকের রঙ ঘৃণা কর।
মার্ক তার কপালে হাত রাখে। তোমার ত্বকের রঙ সম্পর্কে আমি সচেতন নহি।