মার্ক পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে ঘুমন্ত ইয়াসমিনকে দ্যাখে।
মাহজাবীন বলে, না, জাগাইও না। বলিও আমি আসিয়াছিলাম।
মাহজাবীন আবার ঘুমন্ত যুগলকে দ্যাখে। তরুণীটির স্তন সৌষ্ঠব তাকে মুগ্ধ করে। আরেক যুবক যে ঘুমন্ত নয়, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে মাহজাবীনকে, তার পরনে কেবল অন্তর্বাস। যুবকের ধবধবে উরু সে এর আগে এত স্বাভাবিকভাবে দেখে নি। ক্ষণকাল তার চোখ সেখানেও আটকে থক। তারপর সে বলে, বলিও সব ঠিক আছে।
নেমে আসে মাহজাবীন। একেবারে নিচে পৌঁছুতেই, হলের পাশে টুক করে একটা দরোজা খুলে যায়। দাড়িওয়ালা সেই তরুণ উঁকি দেয়। তাকে দেখেই মৃদু হাসে। যেন বলতে চায়, হয়ে গেল। এর মধ্যেই চললে? মাহজাবীন তাকে বলে, এক মিনিটের মধ্যেই আমি আবার আসিতেছি, সঙ্গে একজন বন্ধু থাকিবে। আপত্তি নাই তো?
তরুণ সম্মতি দেয়।
মাহজাবীন বেরিয়ে হাত তুলে ইশারা করে ভাইয়ানকে ডাকে। সে তখনও পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা পেয়ে দ্রুত পায়ে কাছে আসে সে।
কী ব্যাপার?
আলাপ করাইয়া দিব।
কার সঙ্গে? বলতে বলতে ভাইয়ান দূরে গাড়ির ভেতরে বারীকে একবার চট করে দেখে নিয়ে, উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাহজাবীনকে অনুসরণ করে।
সেই রুশ সেফটি-চেন লাগিয়ে দরোজা ফাঁক করে এতক্ষণ দেখছিল, এখন দরোজা খুলে দেয়। তাকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায় ভাইয়ান। তরুণ এখন নিঃশব্দে হাসে, সে আরো অপ্রস্তুত বোধ করে।
মাহজাবীন তাকে আশ্বস্ত করে বলে, বন্ধু।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে দুজন। ভাইয়ান ভ্যাপসা গন্ধটার জন্যে রুমাল বের করবে কি না চিন্তা করে। বদলে জিগ্যেস করে, এখানে কারা থাকে?
মানুষ।
তেতলায় পৌঁছে যায় ওরা। তেতলায় একেবারে ডান দিকের ঘরে ঢুকে জড়াজড়ি করে থাকা যুগলকে দেখে ভাইয়ানের চোখ কপালে উঠে যায়। মেঝের ওপর শুয়ে থাকা, বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখে ভীষণ অপ্রতিভ বোধ করে।
মার্কের দিকে তাকিয়ে মাহজাবীন ক্ষমা প্রার্থনার নীরব হাসি নিবেদন করে। উত্তরে স্নান হাসে মার্ক।
ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারে না ভাইয়ান। তার দৃষ্টি এবার আবিষ্কার করে সবগুলো শাদার ভেতরে একটি বাদামি। ঘুমিয়ে থাকা ইয়াসমিন।
মাহজাবীন ইয়াসমিনের দিকে আঙুল তুলে ভাইয়ানকে বলে, ভালো করিয়া দেখিয়া লউন। আমার জেষ্ঠা ভগিনী। উহাকেই আপনার দেখিতে আসিবার কথা। পছন্দ করিবার কথা। আমাকে নহে।
হতভম্ব হয়ে যায় ভাইয়ান। ইয়াসমিনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।
মাহজাবীন তীব্র গলায় বলে, আর উহাকে দৃষ্টি দিয়া লেহন করিবেন না।
নিচে নেমে, পথে বেরিয়ে মাহজাবীন বলে, বজ্রাহত হইবার অভিনয় না করিলেও চলিবে। আপনার বন্ধুটির মতো আপনিও কন্যা দেখিয়া বেড়ান, বাংলাদেশের বাজারে বহু গাভী আছে।
গাড়ির কাছে এসে মাহজাবীন বলে, নাসরিন, বাহির হও।
তুমি কি আজই বায়োনিক উম্যান কিনিয়া দিবে?
বাহির হও।
মাহজাবীন সরাসরি না তাকিয়েও টের পায়, বসন্তমুখে কালো টেকো ডাক্তারটি কিছু না বুঝেই বোকা হয়ে গেছে, একবার তার দিকে, একবার ভাইয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।
পাতাল রেলপথে বাড়ি ফিরে মাহজাবীন ঘোষণা করে, মাম, ভাবিও না। সে বিদায়। হইয়াছে।
মিস্টার আলি উদ্বিগ্নস্বরে জানিতে চান, কটু ব্যবহার করিস নি তো?
বুঝিলাম না।
জানিতে চাহিতেছি, রূঢ়ভাবে বিদায় দাও নাই তো? সে যে তোমাকে পৌঁছাইয়া দিল না?
সে চাহিয়াছিল।
ও। আশ্বস্ত হন আলি।
ড্যাডি, তোমার নিন্দা হইতে দিব না। বিদায় মুধর হইয়াছিল।
১৭. নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছি
মার্ক, আমি নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছি।
মাঝরাতে কাছের রাস্তা ও দোকানগুলো যখন জনজঙ্গল আর নয়, তখন সোহো স্কোয়ার লোকের ভিড়ে গমগম করছে। চারদিকে এত উজ্জ্বল আলো যে, আলোকেই মনে হয় কলরব মুখোরিত। অধিকাংশ দোকান স্টল, রেস্তোরা খোলা। বিদেশী পর্যটকদের ভিড়। উঁাড়া চিহ্ন দেওয়া ছবি, বিবসনা রমণীর দেহ এবং আসন প্রদর্শনী আর ডিস্কো নাচের আসরগুলোতে মানুষ ভিড় করে ঢুকছে। কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আধ ঘণ্টা পরের সেশনে ঢুকবে, চলতিটায় আসন পায় নি। কেউ জানালায় সাঁটা নগ্ন মেয়েদের পোস্টার দেখছে, ভেতরে ঢুকবে কি না মনস্থির করতে পারছে না। কেউ সুইচ সেন্টারের মাথায় আলোয় লেখা চলমান বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম পড়ছে, রেকর্ডের খোলা দোকানে হ্রাসমূল্য রেকর্ড কিনছে কেউ। সুভ্যেনিরের দোকানে লন্ডন স্মৃতি কিনছে। আর কিছু লোক অলস স্রোতে জলজগুলোর মতো ভেসে চলেছে।
অলবানি স্ট্রীটের দল, ইয়াসমিনের সোনার লকেট বেচার টাকায়, আজ সোহোতে এসেছিল চাইনিজ খেতে। এখন তারা জলজগুল হয়ে গেছে। ভিনসেন্ট, পিটার আর জো একেকটি মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। মার্ক একা পেছনে, ইয়াসমিনও একা, পাশে এবং দূরে।
শরীরের ভেতর দুর্বোধ্য একটা অনুরণন বোধ করে ইয়াসমিন, ব্যাথাটা শারিরীক কিম্বা আত্মীক সে অনেকক্ষণ স্থির করতে পারে না। এমনও মনে হয়, অন্য কারো শরীর ধারণ করে সে চলাচল করছে।
এক সময়ে পিছিয়ে এসে মার্ক পাশে চলতে শুরু করে।
মার্ক, আমি নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছি।
হাঁ, ইহাতে দুঃখিত হইও না। নিঃসঙ্গতা সচেতন ব্যক্তিই অনুভব করে। অস্থির ভেতরে। মার্ক, আমার ভালো লাগিতেছে, এবং লো লাগিতেছে না।