ইংরেজিতে মিথ্যে কথাটা বলে ততটা অপরাধী মনে হয় না নিজেকে।
আমাকে পছন্দ হইয়াছে?
তোমার কী মনে হয়?
মাহজাবীনও মেয়েলিপনা করে, সুর তুলে, বাংলা জবাব দেয়, কেন বলব? মেয়ে বলে না। ছেলে বলে।
ভাইয়ান শরীরের ভেতরে শিহরণ অনুভব করে। এমনকি সে গিয়ার বদলাবার ছুতোয় মাহজাবীনের উরু ছুঁয়ে দেয়। রাগে ভেতরটা দপদপ করতে থাকে মাহজাবীনের। একটা নিষ্ঠুর খেলা তার মাথায় আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ে ফিরে যায় সে।
চুপ করিয়া আছেন কেন? উত্তর দিন। পছন্দ হইয়াছে?
হাঁ খুব পছন্দ তোমাকে।
সত্য?
ঈশ্বর উপরে। আমার বিষয়ে কিছু বলিলে না?
কী বলিব?
আমাকে পছন্দ কিনা?
আমরা যেরূপ শিক্ষা পাইয়াছি, পুরুষের পছন্দকেই একমাত্র জ্ঞান করি। আমি আপনার উপযুক্ত হইতে পারিব কিনা কে জানে, আপনি যে আমাকে দয়া করিয়া পছন্দ করিয়াছেন, আমি সৌভাগ্য বিবেচনা করিতেছি।
ভাইয়ান হাতে চাঁদ পাবার সুখ অনুভব করে। অন্তরে বাঙালি বাইরে ইংরেজ, সোনায় সোহাগা আর কাকে বলে? একেবারে জাত ইংরেজ মেয়ে ঘরে আনতে তার যেমন ভয়, তেমিন পুঁইশাকের গন্ধমাখা বাঙালি মেয়ে তার বিবমিষার উদ্রেক করে। অথচ দুটোরই মজার দিক সে লুটতে চায়। এরকম ভাগে ভাগ আর সে কোথায় পেত। খুশিতে সে মাহজাবীনের কাছে একটা হাতই ক্ষণকালের জন্যে ছুঁইয়ে দেয় বিনা ছুতোয়।
পেছন থেকে খসখসে গলায় বারী বলে, মাদাম তুসো পেরিয়ে গেলাম, ডাক্তার সাহেব। আলবানি স্ট্রীটে যাচ্ছেন তো?
১৬. অধিকার বোধের পাখায় ভর করে
সদ্য অধিকার বোধের পাখায় ভর করে গাড়ি থেকে মাহজাবীনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ানও নেমে আসে। পেছন পেছন দরোজা পর্যন্ত আসবার উদ্যোগ দেখে সে বলে, আপনি অপেক্ষা করুন।
চুপসে গিয়ে ভাইয়ান গাড়িতেও ঢোকে না, সঙ্গেও যায় না। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝুলি থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করে আবার নম্বর মিলিয়ে নেয় মাহজাবীন। তারপর ভারি আর চওড়া কালো কাঠের দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়! দরোজার গায়ে কোনো বেল বোম নেই। তাহলে? হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, এখানে যারা আছে, তারা জোর করে দখল করে আছে। সে দরোজায় করাঘাত করে। সাড়া পাওয়া যায় না। আবার করাঘাত করে। অপেক্ষা করে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায় না। ভুল ঠিকানা নয় তো? কিম্বা বাড়িতে কেউ নেই? এত অভিনয় করে একটা উজবুককে পটিয়ে এতদূর আসাটাই বৃথা হয়ে গেল? পেছন ফিরে তাকায়। রাস্তার ওপারেই পুলিশ থানা। এতক্ষণ থানার নীল চৌকো ডোমবাতিটা চোখে পড়ে নি। এখন দেখেই কেমন ভয় করে মাহজাবীনের। থানার এত কাছে? এদের সাহস আছে বলতে হয়?
ক্যাঁচ করে শব্দ হতেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিল আর কী। তাকিয়ে দ্যাখে চওড়া দরোজার ভেতর থেকে একটুখানি ফাঁক করে ঘন দাড়িওয়ালা এক শ্বেতাঙ্গ উঁকি দিয়ে নিঃশব্দে তাকে দেখছে। দরোজা ভেতর থেকে সেফটি-চেন দিয়ে আটকান।
অনেকক্ষণ পর দাড়ির ফাঁকে হাসি বিচ্ছুরিত হয়।
কাহারো সাক্ষাতপ্রার্থী?
হাঁ। আমার ভগ্নী এখানে থাকে।
তাহার কী নাম?
ইয়াসমিন। মাত্র গতরাত্রি আসিয়াছে।
হাঁ, উহারা ত্রিতলে আছে।
সে ভেতরের চেন খুলে দেয়। মাহজাবীন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ গতিতে দরোজা বন্ধ করে দেয় তরুণটি। তারপর মাহজাবীনের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিপাত করে নিঃশব্দে হাসে। বলে, আমাদের সাবধান থাকিতে হয়। মালিক জোর করিয়া ঢুকিতে পারে। পুলিশ আসিতে পারে। ঐরূপ আলামত দেখিলে আমরা দরোজা খুলি না। তোমার ভগ্নী অপেক্ষা তুমি সুন্দর। যাও, সিঁড়ি বাহিয়া ত্রিতলে সর্বদক্ষিণ দরোজায় ঘা দিবে। সেখানে আছে।
সিঁড়িগুলো অত্যন্ত চওড়া এবং বেশ উঁচু উঁচু। দরোজা জানালা অতিকায়, ছাদ গগনস্পর্শী প্রায়। বাড়ির ভেতরে ভ্যাপসা গন্ধ। বাড়ির প্রাচীনত্ব, অধিবাসীদের বিচিত্র রান্না, আর তামাকের ধোঁয়া মিলিয়ে গন্ধটা স্থির ঝুলে আছে। মাহজাবীন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে না ভেবে পারে না, ইয়াসমিন এখানে থাকবে কী করে? শুভাকাঙ্ক্ষার ক্ষীণ একটা জ্যোৎস্না তার ভেতরে বিকীর্ণ হতে থাকে।
তেতলায় উঠে একেবারে ডান দিকের দরোজা আধো খোলা দ্যাখে সে। কাছে এসে উঁকি দেয়। কয়েকজন তরুণ তরুণীকে দেখা যায়। ইয়াসমিনকে দেখা যায় না। তারা মাহজাবীনের দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু অবাক হয় না, কিম্বা চোখে কোনো প্রশ্ন আঁকে না। একটি মেয়ে আমন্ত্রণের হাসি নিয়ে ভেতরে আসতে ইশারা করে তাকে। দরোজা ঠেলে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় ইয়াসমিনকে। ছেড়া এক টুকরো কার্পেটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, চোখ বোজা, মনে হয় মৃত। বুকের ভেতরে ছাৎ করে ওঠে মাহজাবীনের। পা অবশ হয়ে যায়। ব্যাকুল চোখে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
সে ঘুমাইতেছে।
মাহজাবীন তাকিয়ে দ্যাখে, গিটার কোলে এক তরুণ। তার আরো চোখে পড়ে, শুধু ইয়ামিন নয় আরো তিন জন ঘুমিয়ে আছে। এক তরুণ তরুণী প্রায় নগ্নদেহে নিবিড় আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে ঘুমুচ্ছে। ঘরের এক পাশে গ্যারাফিন হিটার জ্বলছে। তার উত্তাপে উষ্ণ এবং সুখী মনে হয় যুগলদেহ। ক্ষণকাল আগের আশংকায় মাহজাবীন নিজেই ব্ৰিত বোধ। করে। সহজভাব হাসে সে।
মার্ক বলে, আমি মার্ক, তুমি ইয়াসমিনের ভগিনী।
হাঁ, এই ব্যাগ দিতে আসিয়াছি। দেরি করিতে পারিব না।