হাঁ। আমিই আপনাকে করিয়ে দিতে পারি। কজন আসবে?
একজন। সেই একজনই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসাটা পাবার জন্য আলি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন।
তা এ রকম বোঝা তো আমাদের বইতেই হয়। তবু তো আপনি এখানে আছেন, পাউন্ড রোজগার করছেন, দেশের বোঝা যতই হোক, অতটা নয়। টাকায় উপার্জন করে বোঝা। টানা, সে যারা টানে তারা বোঝে।
তা অবশ্য।
ভদ্রলোককে বেশ বিচলিত দেখায়। আলির চোখ এড়ায় না।
যাকে আনতে চান তার এনট্রি পারমিট এ-সব আছে তো? সে কিন্তু লম্বা ঝামেলা। বিশেষ করে এখন।
না, না, সে-সব আছে। কোনো অসুবিধে নেই। আমারই মেয়ে, এখানে এতদিন আমার কাছেই ছিল।
আলি হঠাৎ ব্যবসায়ী থেকে পিতা হয়ে যান। কৌতূহল হয় তার।
আপনার মেয়ে?
হাঁ, আমার মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। তাকে আনতেই দেশে যাচ্ছি। আর বলবেন না। ভদ্রলোক সখেদে উচ্চারণ করে গুম হয়ে বসে থাকেন খানিক।
পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কেন?
না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। বাঙালিয়ানা সব ভুলে যাচ্ছিল। আমাদের ফ্যামিলিতে ও-সব তো চলে না। একেবারে বাড়াবাড়ি দেখে বহুকষ্টে জোরজার করে বছরখানেক আগে ঢাকা পাঠিয়ে দিই আমার শশুরের কাছে।
আলি ব্যগ্র হয়ে জিগ্যেস করেন, তারপর?
একে সেখানে বাবা নেই, মা নেই, নানা-নানী। আলি সাহেব, অনেকদিন থেকেই আপনাকে জানি, নিজের লোক মনে করি, তাছাড়া আপনারও ফ্যামিলি আছে, ঢাকা নাকি এখন লন্ডনকেও ছাড়িয়ে গ্যাছে।
বলেন কী? এত অভাব অভিযোগ।
রাখুন সাহেব অভাব অভিযোগ। সে তো নিচের তলায়। আর অভাব অভিযোগের সঙ্গে তো আপনার, কী বলে, ভ্যালু জাজমেন্ট বা মরালিটির কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকায় মেয়েরা এখন যা করছে অনেক ইংরেজ মেয়েও নাকি তা করতে দুবার চিন্তা করবে।
প্রতিবাদ করতে প্রেরণা পান আলি, কিন্তু নিজের মেয়ের কথা টেনে যখন বলছেন, ভদ্রলোককে অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ থাকে না।
করিম সাহেব বলেন, যাকগে, এখন ঠিক করেছি ফিরিয়ে আনব। আমার কাছেই রাখব। কাছে থেকেই সহ্য করতে পারি নি, দূর থেকে শুনে কি সহ্য হয়? আপনি তাহলে মেয়ের একখানা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিন।
শুকনো গলায় আলি বলেন, করব। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি দিয়ে আসব। আপনার বাসায়।
সে তো ভালোই হয়, খুব ভালো হয়। আমার যা মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। মেয়েকে নিয়ে না আসা পর্যন্ত শান্তি নেই। সে তো আসতেই চায় না। তাই যাচ্ছি।
আসতে চায় না কেন?
তেতো গলায় করিম সাহেব বলেন, নিজে বোঝেন না? সেখানে সুযোগও আছে, স্বাধীনতাও আছে।
টিকিটের দাম চেক লিখে দিয়ে বজলুল করিম ধীর পায়ে বেরিয়ে যান।
১৫. ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট
ইলিং থেকে আলবানি স্ট্রীট দূর হলেও সোজা রাস্তা। ওয়েস্টার্ন এভ্যেনু ধরে গেলেই হলো। মাদাম ত্যুসো-র মোমপুতুলের যাদুঘর পেরিয়ে একটু পরেই বাঁ হাতি রাস্তা। ভাইয়ানের হাতে গাড়ি উড়ে চলে। মাহজাবীন অনেকক্ষণ কোনো প্রসঙ্গ তোলে না বলে, তার সন্দেহ হয়, মেয়েটি তাকে অপছন্দ করছে না তো?
ভাইয়ান অনেক ভেবে কোনো প্রসঙ্গ না পেয়ে হাতের কাছে যা খুঁজে পায় তাই তোলে। গাড়ি কেমন?
মাহজাবীন সংক্ষেপে উত্তর দেয়, উত্তম।
তুমি কি একেবারেই বাংলা বলতে পার না?
কিছু কিছু পারি। অনেক বুঝি।
এই তো সুন্দর বাংলা বলছ।
ভালো একসপ্রেশন হয় না।
চেষ্টা করলেই হবে। বাঙালি মেয়ে, বাবা-মা বাঙালি, চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে। ইংরেজ তো আর নও।
লোকটির কথা শুনে গাড়ল মনে হয় মাহজাবীনের। তবু অলবানি স্ট্রীটে লোকটার ঘাড়ে চেপে যাওয়া যাচ্ছে, মাহজাবীন মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে।
পেছন থেকে অনেকক্ষণ পর বারী মুখ খোলে। মাহজাবীনকে লক্ষ্য করে বলে, বুঝতে পারছেন না? বাংলায় একটা কথা আপনার মুখ থেকে শুনতে চায়। গাড়ির কথা জিগ্যেস। করছিল, গাড়ি কেমন? গাড়ি নয়, নিজে কেমন সেটাই আসল প্রশ্ন। দিয়ে দিন উত্তর। বলে হা হা করে হাসে লোকটা।
বুঝিলাম না।
জানিতে চায়, গাড়ি নয়, গাড়ির মালিক আপনার পছন্দ হইয়াছে কি?
বড় স্কুল মনে হয় মাহজাবীনের। এক ঘণ্টার আলাপেই এরা একটি মানুষের পাজামার ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। নিষ্ঠুরভাবে সে খেলাতে শুরু করে তখন। বারীকে বলে, আপনি বিবাহিত?
না। সৌভাগ্যবান নহি।
বিবাহ করিবেন?
কন্যা পাইলে করিব।
কন্যা পান নাই।
পাইয়াছি অনেক। পছন্দ হয় নাই।
এখনো বাজার করিয়া চলিয়াছেন?
হাঁ, আশা ছাড়ি নাই।
মুল্যহ্রাসের আশায় রহিয়াছেন কি?
রসিকতাটি ঠিক রসিকতা নয় বলে বারীর সন্দেহ হয়। সে হাসতে গিয়েও আধখানা হেসে বিসদৃশভাবে চুপ হয়ে যায়।
লক্ষ রাখিবেন, ইতিমধ্যে স্বয়ং আপনার মূল্য না হ্রাস হইয়া যায়। ঈশ্বর না আপনার দেহে বিরাট মূল্যহ্রাস ঝুলাইয়া দেন।
গুম হয়ে যায় বারী। গোড়াতেই তাকে যে এতদুর টেনে আনা হয়েছিল, এর জন্যে আবার সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে মনে মনে।
মাহজাবীন এবার ভাইয়ানকে নিয়ে পড়ে। তার ওপর রাগটা আরো বেশি, কারণ এই লোকটিই তো ইয়াসমিনকে গাভীর মতো ব্যবহার করতে চায়।
আপনি কী রকম বাজার করিয়াছেন?
আমি? না, একেবারেই না, মোটেই না।
আমিই প্রথম?
ভাইয়ান আমতা আমতা করে।
মাহজাবীন বলে, সত্য বলিলে কিছু মনে করিব না।
ভাইয়ান বলে, মিথ্যে করে বলে, এই প্রথম কন্যা দেখিতে আসিলাম।