নাহার বলে, কাল পার্টিতে যাবার আগে বলছিল, মা, সতের বছর বয়সে তো তোমারও বিয়ে হয় নি। বিলেতে এসে তোক সভ্য হয়, তোমরা আরো পেছন দিকে যাচ্ছ।
সব তোমার আশকারা।
নাহার সত্যি সত্যি অবাক হয়।
আমার আশকারা?
নয়তো কী? এই যে পার্টি, কাল সন্ধে বেলায় পার্টিতে গেল, কখন ফিরল, কার সাথে ফিরল, খোঁজ করে দ্যাখ? ইংরেজ মা হয়েছ? মেয়েকে নিশ্চিন্তে অজানা অচেনা জায়গায়। ছেড়ে দিচ্ছ?
খোঁজ নিলে রাগ করে যে।
কেন? রাগ কীসের?
খোঁজ নিলে নাকি অবিশ্বাস করা হয়। সভ্য সমাজে ছেলেমেয়েকে বিশ্বাস করা হয়।
রাখ তোমার সভ্য সমাজ।
নাহার রাগ করে এবার।
আমার হয়েছে যন্ত্রণার একশেষ। একদিকে তুমি, আরেক দিকে মেয়েরা।
মেয়েরা বোলোলা না। আমার মাহজাবীন অন্য রকম মেয়ে। আদব কায়দা আছে।
মাহজাবীন ইয়াসমিনের দুবছর ছোট। বারো বছর আগে যখন এ দেশে প্রথম এসেছিলেন আলিরা, ইয়াসমিন সাত, মাহজাবীন পাঁচ। লন্ডনে তাদের তৃতীয় মেয়ের জন্ম হয়। নাসরিন, সে এখন ন বছরের।
আলি আরো বলেন, নাসরিন যদি নষ্ট হয় তো ঐ ইয়াসমিনের জন্যেই হবে।
ঝংকার দিয়ে ওঠে নাহার, বাড়িতে তুমি আছ কী করতে? মেয়েকে শাসন করতে পার না?
যাও, মেয়েকে বল, ডাক্তার এলে যেন ভালো ব্যবহার করে।
মেয়েদের সঙ্গে একটা দুরত্ব বজায় রেখে চলেন আলি। সেই রকমই দেখে এসেছেন তিনি তার বাপজানকে, সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে। আলি যখন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন, ইচ্ছে করেই সংক্ষিপ্ত এবং রুঢ় হন, পাছে স্নেহ প্রকাশ পেয়ে যায়। নাহার ভালো করেই জানে, আলি নিজে থেকে মেয়ের ঘরে যাবেন না, বা এ ঘরে ডাকবেন না। তাই চ্যালেঞ্জটা। ছুঁড়ে দিয়ে আলির অস্বস্তি সৃষ্টি করে তার এক ধরনের জিৎ হয়ে যায়। সোনালি সেই আভায় উজ্জ্বল হয়ে যায় সে। মনটাও স্বামীর অনুগত হয়ে যায় আবার কয়েক মুহূর্তের বিচ্যুতির পর।
নাহার বলে, তোমাকে আর মেয়েকে এক সঙ্গে চা দিচ্ছি। খেতে খেতে চট করে কথাটা বলে কাজে চলে যাও। বাকি আমি দেখব।
ডাঃ ভাইয়ানের কথা শুনে দেখার আগেই তাকে খুব পছন্দ হয়েছে নাহারেরও। তাছাড়া, তার মনের মধ্যে কিছুদিন থেকেই এ আশংকাটা দেখা দিয়েছে, ইয়াসমিন হয়তো লাগাম। ছাড়া হয়ে যাবে। বয়স না হয় সতেরই হলো, বাড় কুড়ি-একুশের, এখন একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে নাহার নিশ্চিন্ত হতে পারে।
যাই, তোমার মেয়ে হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে।
ডাক্তার আজ আসছে যখন জান, কাল পার্টিতে যেতে দেয়া ঠিক হয় নি।
তাহলে আজ আর দেখতে হতো না।
নাহার মেয়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
শোন।
নাহার ফিরে দাঁড়ায়।
এক কাজ কর না হয়। আলি ইতস্তত করে বলেন, আমি আপিসে গিয়ে বসছি। তুমি মিনাকে চা দিয়ে পাঠাও। আপিস খুলতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। এক ক্লায়েন্ট আসবার কথা। বলে তিনি আর এক মুহূর্ত দাঁড়ান না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান।
০২. তিনটে শোবার ঘর
ওপরে, তিনটে শোবার ঘরের সবচেয়ে ছোট ঘরখানা বড় মেয়ের, মানে ইয়াসমিনের। মাঝারি ঘরে থাকে মাহজাবীন আর নাসরিন। আলিদের শোবার ঘরটা বড়, কেউ এলে
সেখানেই বসবার ব্যবস্থা। নাহার গিয়ে ইয়াসমিনের দরোজায় টোকা দেয়।
এই অভ্যাসটি বহু কষ্টে মাকে শিখিয়েছে ইয়াসমিন। আগে তো হুট করে ঢুকে পড়ত নাহার, প্রতিবারই ইয়াসমিন এমন করে উঠত যেন তার গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তিড়িং বিড়িং করে লাফাত আর চাচাত। নাহার বুঝতেই পারত না, মেয়ের ঘরে মা ঢুকবে তার আবার নোটিশ কীসের? মেয়ে কি পর? না, মা পেটে ধরে নি তাকে? শেষে মেয়ের জেদে পড়ে অভ্যাসটা করে নিয়েছে সে। তাও মাঝে মধ্যে ভুল হতো। সেটা একেবারেই শুধরে যায়, যখন ইয়াসমিন তার এক জন্মদিনে ক্লাশের একগুচ্ছ বান্ধবীর সমুখে বলে বসল, তারা এখন নিজেদের ভেতরে গল্প করবে, মা যেন জানান না দিয়ে ঘরে না আসে, যেমন তার অভ্যেস।
দরোজায় আবার টোকা দেয় নাহার।
ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
কাল কত রাতে ফিরেছে? কাল ওর এক বান্ধবীর জন্মদিন ছিল। কয়েকজন মিলে সিনেমা দেখবে, তারপর চাইনিজ টেক-অ্যাওয়ে খাবার এনে বান্ধবীর বাসায় খাবে, একটু হৈ-চৈ করবে, ফিরে আসবে। কতই বা রাত হতে পারে? সাড়ে বারোটা পর্যন্ত নাহার নিজেই জেগেছিল। ইয়াসমিনের দেরি দেখে একটু ভাবনা হয়েছিল তার, কিন্তু প্রকাশ করলে স্বামী তুলকালাম করে ছাড়তেন। তাই সে ঘুমন্ত আলিকে আর জাগায় নি। তারপর নিজেও সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এর আগেও কয়েকবার এ রকম দেরি করেছে, চাবি দিয়ে দরোজা খুলে পা টিপে টিপে ওপরে এসেছে। নাহার কিছু বললেই বলেছে, তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে, তার সব বান্ধবীই এ স্বাধীনতা পায়, তাছাড়া বয়স ষোল হয়ে যাবার পর মানুষের স্বাধীনতা আছে যতক্ষণ খুশি বাইরে থাকবার, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারে মা কিম্বা যেই হোক মাথা গলানোটা অশালীন।
নাহার এবার নাম ধরেই ডাকে।
মিনা।
তবু সাড়া পাওয়া যায় না।
মেয়ের কাছে তিরস্কৃত হবার আশংকার চেয়ে উদ্বেগটাই লাফ দিয়ে প্রকাণ্ড হয়ে যায়।
হাতল ঘোরাতেই দরোজা খুলে যায়, দরোজা খুলে দেখা যায়, ইয়াসমিন বিছানায় নেই। নেই, তবু বিশ্বাস হয় না। চোখের ভুল বলে মনে হয়। ছোট্ট এতটুকু ঘর–একবারেই চোখে সবটা মেপে নেয়া যায়। ঘর শূন্য। বিছানা অগোছালো। হয়তো রাতে কেউ ঘুমিয়েছিল, হয়তো কেউ ঘুমোয় নি, বোঝা যায় না। ইয়াসমিন বিছানা করতে বড় আলসে। যেমন ঘুম থেকে উঠে যায়, তেমনি রাতে এসে বাসি বিছানায় শুয়ে পড়ে। নাহার কিছু বললে খেপে ওঠে। বলে, সে কি হলওয়েল কারাগারে বন্দি যে রোজ ভোরে ওয়ার্ডেনের রোদে বেরুবার আগেই তাকে বিছানা করে রাখতে হবে, রেখে বিছানার পাশে নিষ্পাপ। সন্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?